[নানান দেশকালে হিজাবের অর্থ এবং হিজাব পরা-না-পরা নিয়ে শুধু ‘অমুসলমান’-এর নয়, অনেক মুসলমানের মনেও কিছু প্রশ্নের উদয় হয়। তেমনি কিছু প্রশ্নের জবাবে শায়খ ফাদল ২০১৬ সালে একটা বিশদ ফতোয়া দেন। বাংলাদেশ এবং সংলগ্ন অঞ্চলের জন্যেও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এখানে হিজাব সম্পর্কে সেই ফতোয়ায় ফাদলের প্রধান বক্তব্যের অংশটুকুর বাংলা অনুবাদ হাজির করা হলো। ফতোয়াটির সুত্রঃ https://www.searchforbeauty.org/2016/01/02/fatwa-on-hijab-the-hair-covering-of-women/ ।
শায়খ ডঃ খালেদ আবু এল ফাদল ইসলাম, শরীয়া ও ইসলামী আইন বিষয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। সেখানে তিনি পড়ান ইসলামিক জুরিসপ্রডেন্স, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, আইন ও সন্ত্রাস, আইন ও নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। এর আগে তিনি টেক্সাস, ইয়েল ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আইন পড়িয়েছেন।
প্রভাবশালী জার্নাল ও পত্রিকায় অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত প্রবন্ধ ও কলামের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। তার মধ্যে Speaking in God’s Name: Islamic law, Authority and Women, And God Knows the Soldiers: The Authoritative and Authoritarian in Islamic Discourses, The Great Theft: Wrestling Islam from the Extremists, The Search for Beauty in Islam: Conference of the Books, Reasoning with God: Reclaiming Shari’ah in the Modern Age ইত্যাদি আলোচিত, আদৃত, প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। তিনি উসুলি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা। সাইটঃ https://www.usuli.org/ ।
ইসলামী আইন, নারী এবং কর্তৃত্বের প্রশ্নে শায়খ ফাদলের Speaking in God’s Name: Islamic law, Authority and Women বইটা আগ্রহী পাঠকেরা পড়তে পারেন। ]
#
হিজাব সম্পর্কে ফতোয়া
শায়খ খালেদ আবু এল ফাদল
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে।
আসসালামু আলাইকুম। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মুসলমান নারী আমাকে মাথার আবরনী পরা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, যা সাধারণত হিজাব হিসাবে পরিচিত। পাশ্চাত্যে মুসলমানদের উপর বৈরীতা ও বিদ্বেষ বেড়ে যাচ্ছে দেখে অনেক নারী জানতে চাচ্ছেন, হিজাব না পরা শরীয়া মতে জায়েজ কিনা। এই নারীদের কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন এবং/ অথবা মুসলমানদের বিদেশীভাব(foreignness), ও ভিন্নতা (alienness) নিয়ে নাগরিক উৎকন্ঠা (public anxiety) দূর করার আকাংখা ব্যক্ত করেছেন। এই সব প্রশ্নগুলোই কিন্তু স্পষ্ট করছে যে মস্তকাবরণ পরা আধ্যাত্মিক বা অন্য ধরনের সংকটের কারণ হয়ে পড়ছে। অতীতে আমি এই জিজ্ঞাসাগুলোর আলাদা আলাদা উত্তর দিয়েছি। হিজাব পড়া নিয়ে মাস ছয়েক আগে আমি একটি ফতোয়া দিয়েছি। কিন্তু, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে, ও মুসলমানদের প্রতি ইসলামোফোবিক সহিংসতা বেড়ে গেলে, আমি বিষয়টি নিয়ে জনসমক্ষে ও বিশদভাবে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন সর্ববিষয়ে আমাকে পথ দেখান এবং আমার ভুলগুলো ক্ষমা করে দেন।
আমার মতে, মুসলমান নারীদের মস্তকাবরণ বা হিজাব পরা ভুল হবে, যদি এটা পরার ফলে তারা অন্যদের অযাচিত মনোযোগের কারণ হয়, বা নিজেরা বিপদে পড়ে, অথবা এটা যদি নিজের ধর্মীয় পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বা ইসলামী মেসেজের সত্যতা অমুসলমানদের জানাতে বাধা সৃষ্টি করে। আদব বা প্রায়োগিক নীতিশাস্ত্র বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, ভালো ও আকাঙ্খিতকে মন্দ ও অনাকাঙ্খিত থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে মানুষের চর্চা ও অভ্যাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘আল-মারুফের’ সাথে ‘আল-মুনকারের’ পার্থক্য এখানেই। ‘মারুফ’ হচ্ছে ঐ জিনিষ যা মানুষ তাদের প্রায়োগিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ভালো বলে চিহ্নিত করেছে। আর ‘মুনকার’ হচ্ছে তা যা মানুষ তাদের প্রায়োগিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সামাজিকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত করে। তবে প্রায়োগিক নীতিবিদ্যার অন্যসব প্রশ্নের মতো, এখানেও বিতর্ক উঠতে পারে- কোনো কিছুকে সামাজিকভাবে আকাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত দাবী করার পেছনে প্রাসংঙ্গিক অভিজ্ঞতাবাদী ভিত্তি কি! যেমন, উদাহরণস্বরূপ, প্রাসঙ্গিক বলতে কি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, জাতি বা অন্য কোনো সামাজিক বর্গের(unit) মুসলমানদের চর্চার কথা বলা হচ্ছে? নাকি পুরো মানবজাতির চর্চাকে বোঝানো হচ্ছে? নাকি কোনো একটা অঞ্চল বা জাতীর মুসলমান ও অমুসলমানদের চর্চাকে বোঝানো হচ্ছে? সঠিক সীমা ও সীমানা কোনগুলো?
কোরানে নারীদের পোষাক ও শালীনতার উল্লেখ পাওয়া যায় মূলত দুই জায়গায়ঃ ১) প্রথম জায়গায় কোরান বলছেঃ এবং বিশ্বাসী নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের শালীনতা হেফাযত*(১) করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য ও অলংকার (জিনা)*(২) প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের বক্ষে আঁচল (খুমুর/khumur) টেনে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য (জিনা) প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের সাজ-সজ্জা (zīnatihinna) প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। (কোরান ২৪:৩১)
২) দ্বিতীয় জায়গায় কোরান বলছেঃ হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে*(৩) বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের (jalābīb) কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। (কোরান ৩৩: ৫৯)
প্রথম আয়াতের কথা বলতে গেলে, প্রশ্ন উঠতে পারে খিমার (বহুবচনে- খুমুর) কি এবং খিমার কি ঢাকার কথা? অনেক পন্ডিত যুক্তি দিয়েছেন, খিমার এমন এক টুকরা কাপড় যা নারীর সমস্ত শরীরকে ঢাকে এবং মুখের উপর টেনে দেওয়া হয়, যা কার্যত নারীর সমস্ত শরীরকেই আবৃত করে। অন্য অনেক পন্ডিত দাবী করেছেন খিমার এমন এক টুকরা কাপড় যা নারীর চুল ও সমস্ত শরীরকে ঢাকে- শুধুমাত্র মুখ ছাড়া। যাহোক, আমি মনে করি -এবং আল্লাহই সবচে ভালো জানেন- উভয় দলের ভাবুকরাই, অর্থাৎ যারা দাবী করছেন খিমার মুখ ঢাকে ও যারা দাবী করছেন খিমার চুল ঢাকে কিন্তু মুখ নয়, তারা ইতিহাসে নাই এমন কিছু বলছেন। কারণ তারা এমন একটি ঐতিহাসিক চর্চার কথা অনুমান করছেন, যার কোনো প্রমাণ নাই। ইসলামপূর্ব হিজাজে খিমার দিয়ে মুখ নাকি চুল ঢাকা হত- এ রকম কোনো তথ্য প্রমাণ নাই। এই আয়াত থেকে যা নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা হল মুসলমান নারীদেরকে বুকের (juyūb) উপর এক টুকরা কাপড় (khimār) টেনে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা চুল বা মুখ ঢাকতো কি না- আমরা জানি না। অন্যকথায়, এই আয়াতে কোরান নারীদের বুক ঢাকার জন্য বলছে। এর বেশি কিছু বলতে গেলে কোরান নাজিল হবার সময়কালে খিমার পরিধানের সামাজিক চর্চার উপর দীর্ঘ অনুসন্ধানের দরকার পড়বে। এর ঐতিহাসিক প্রমান সমসাময়িক অনেক পন্ডিত যতটা মনে করেন, তারচে অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধরণের ও জটিল।
খিমারের বিষয়টি জিনার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কোরানের প্রথম আয়াতটি শুরু হচ্ছে একটি নির্দেশ দিয়ে, মুসলমান নারীরা যাতে তাদের জিনা প্রদর্শন না করে, এবং এরপর বলা হচ্ছে, খিমার দিয়ে বুক ঢাকতে হবে। দৃষ্টি নত রাখা, শালীন হওয়া ও জিনা প্রদর্শন না করার চর্চার বিপরীত কি বলে বিবেচিত হয়- তা-ই এই আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যভাবে বললে, কোরান শুরু করছে দৃষ্টি নত রাখার বিধানসহ শালীনতার একটা নমুনা তৈরী করার মাধ্যমে। এরপর নির্দিষ্ট করে বলছে যে শালীনতার সাথে গ্রহণযোগ্য সম্পর্কের মানুষ যেমন স্বামী, পিতা, অথবা ছেলে ছাড়া অন্যদের সামনে জিনা প্রদর্শন না করার বিষয়টা যুক্ত। খিমার দিয়ে বুক ঢাকার বিষয়টি এরপর আসছে।
জোরে পদচারণার বিষয়টি খুব সম্ভবতঃ একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে নির্দেশ করছে। কোরান নাজিল হওয়ার সময়কালে দেহোপজীবিনীরা পায়ের গোড়ালিতে ব্রেসলেট পরতো যা হাঁটার সময় শব্দ করতো- এ রকম একটা বিবরণ পাওয়া যায়। স্পষ্টতই, এটা করা হতো তাদের ব্যবসার বিজ্ঞাপনের জন্য। এই বিবরণ ঐতিহাসিক হোক বা না হোক, জোরে পদচারণা ও অলংকার প্রদর্শনের না করার উল্লেখ করা হয়েছে শালীনতা শেখানোর জন্য ও নিজের উপর অযাচিত মনোযোগ নিয়ে না আনার জন্য।
বেশিরভাগ সমসাময়িক পন্ডিত আওরা (গোপনাঙ্গ) ও জিনার মধ্যে পার্থক্য করে না। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, তারা অনুমান করেন গোপনাঙ্গ প্রদর্শন করা জিনার সমান বা তুলনীয়। আওরা শব্দটি কোরানের দুটি প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছেঃ ২৪:৩১ এবং ২৪:৫৮ এ। উভয় ক্ষেত্রেই এটি গোপন ও ব্যক্তিগত এমন কিছু বোঝায়। হাদিসে ‘আওরা’ শব্দটি এমন কিছু বোঝায় যা ব্যক্তিগত এবং যাকে লুকিয়ে বা নির্জনে রাখতে হবে। একটা হাদিস আছে যা নারীদেরকেই নির্বিশেষে ‘আওরা’ বলছে, যদিও এই হাদিসের মর্মার্থ, পরিপ্রেক্ষিত এবং এটা কতটা সহি তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। ফিকাহ শাস্ত্রে ‘আওরা’ নির্দেশ করে গোপনাঙ্গসমূহকে যাদের ঢেকে রাখা উচিত এবং প্রকাশ করা উচিৎ না। আগেই যেমন উল্লেখ করেছি, সমসাময়িক পন্ডিতরা ‘আওরা’ এবং ‘জিনা’র মধ্যে পার্থক্য না করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যকথায়, তারা কোরানের জিনার উল্লেখকে অচেনা মানুষের সামনে নারীর আওরার উল্লেখ হিসাবে পাঠ করে। এভাবে জিনা ও আওরকে মিলিয়ে ফেলা অন্যায্য। জিনা হচ্ছে যা দিয়ে একজন মানুষ নিজেকে সাজায় অথবা একজন মানুষ অন্যের চোখে পড়ার জন্য বা অন্যকে আকর্ষণ করার জন্য যা প্রদর্শন করে। আমার মতে, জিনা বা অলংকার বলতে কি বোঝায় তা ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্রের প্রশ্ন। মানে, এটা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে, এক কাল থেকে অন্য কালে আলাদা হয়। আফ্রিকার কোনো একটা অংশে যে সৌন্দর্যকরণকে অশালীন অলংকারিক প্রদর্শন বলে ধরা হয়, মঙ্গোলিয়ায় তা সম্পুর্ণ ভিন্ন হবে। মূল কথা হল, কোরান শরীরের অশালীন প্রদর্শন না করার কথা বলছে। চুল প্রদর্শন যে নারীর জিনার অংশ এমন কোনো প্রমাণ নাই। স্থান ও প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে, চুল না ঢেকেও নারী শালীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে এবং এর বিপরীতটাও সত্য। একজন নারী চুল ঢেকেও অশালীনভাবে নিজের জিনা প্রদর্শন করতে পারে। আমার মতে, বিভিন্নভাবেই এটা পরিষ্কার যে, কোরান এখানে দৃষ্টি নত রাখা, শালীন হওয়া, ঝলক দেখানো ও নিরর্থক দম্ভ প্রকাশ থেকে বিরত থাকার দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত বাইবেলের আদেশকে দৃঢ়ভাবে পূনর্ব্যক্ত করছে।
এবার দ্বিতীয় সূরাটিতে যাই। আরবি টার্মিনোলজিতে বলা হচ্ছে জিলবাবকে (বাইরের পোশাক) নিচে নামানোর জন্য, যাতে শরীরের নিম্নাংশ ঢাকা যায়। জিলবাব হচ্ছে পুরুষ ও নারীর পরিধেয় বাইরের পোশাক যা শরীরের অনির্দিষ্ট অংশ ঢাকে। (অনুবাদক এম.এ.এস আবদেল হালীম সঠিকভাবেই দেখাচ্ছেন যে কোরানে শব্দটা যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে পোশাককে ‘নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখা’। এর অর্থ ‘আবৃত করা’ না, যা অন্য অনুবাদকরা অনুমান করেছেন।) সূরার প্রেক্ষিত ইংগিত করছে যে, এর নাজিল হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি নাজিল হওয়ার সময়ের একটি নির্দিষ্ট সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। উপরে উল্লেখিত আয়াতের পরের আয়াতে থেকেই এটি পরিষ্কার হচ্ছে। আয়াত ৩৩:৬০ ঐ পুরুষদের (নিপিড়নকারী, যৌন আক্রমণকারী) যারা এই সমস্যাটা ঘটাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে এই বলে যে, যদি মদিনার এই ভন্ড, বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তি ও কুৎসা রটনাকারীরা অনিষ্ট ঘটানো থেকে বিরত না হয়, তাদের সবাইকে শহর থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। অনেক উৎস থেকে এই বিবরণ পাওয়া যায় যে, নবীর সময়ে বদমাশরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো এবং দাসীদের নিপীড়ন ও যৌণ আক্রমণ করতো। দাসী না হয়ে মুক্ত নারী হলে তারা কাছে ঘেঁষতো না। কিছু ধ্রুপদী পন্ডিত দাবী করছেন যে এই সূরা নাজিল হবার উদ্দেশ্য ছিল মুক্ত নারীদের জিলবাব দিয়ে নিজেদের ঢাকার মাধ্যমে দাসীদের থেকে পৃথক করা, কারণ দাসীরা জিলবাব পরতো না। অন্যান্য উৎস দাবী করছে এর উদ্দেশ্য ছিল ঠিক তার উল্টোঃ মুসলমান নারীরা জিলবাব দিয়ে নিজেদের ঢাকবেন যাতে বদমাশরা কে দাসী কে মুক্ত নারী তা আলাদা করতে না পারে। এর ফলে তারা কাউকেই নিপীড়ন করতে পারবে না। সূরার ভাষা থেকেই এটি পরিষ্কার যে এই আদেশের উদ্দেশ্যে হচ্ছে নারীদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা। আমার মতে, এটাও পরিষ্কার যে এই বর্ণনাটিবিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ন্যায় ও বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের নারীদের প্রতি অভিন্ন আচরণকে সাপোর্ট করার চেষ্টা করেছে।
এই দুইটি সূরা থেকে আমার যা পরিষ্কার মনে হচ্ছে তা হল, কোরান শালীনতা ও বিনম্রতার উপর অনেক জোর দিচ্ছে। খিমার ও জিলবাবের বর্ননার মাধ্যমে বর্তমান যুগে যাকে হিজাব বলা হয় তার মতো অভিন্ন ও চূড়ান্ত কোনো মস্তকাবরণকে বোঝাচ্ছে না।
নারীদের ‘আওরা’ বলতে কি বোঝানো হচ্ছে তার বেশিরভাগ হাদিস থেকে আসছে। একটা হাদিসে বলা হচ্ছে মুহাম্মদ (সঃ) আসমাকে জানাচ্ছেন, বয়ঃসন্ধি অতিক্রম করলে কোনো নারী যে অঙ্গগুলো দেখাতে পারবেন তা হচ্ছে হাত ও মুখ। এই হাদিসটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে এবং কম করে বলতে গেলেও, এর ইসনাদ (হাদিসের ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র) সমস্যাজনক। আয়েশার উপর আরোপিত আরকটি বিবরণ বলছে, নবীর জীবনের শেষ বছর যখন হিজাব পরার আদেশ হল, নারীরা সত্তর তাদের মাথা ঢেকে ফেললো- এতে তাদের ‘কালো কাকের’ মত লাগতো। কিন্তু এই হাদিস কতটা সহি তার সাথে জড়িয়ে অনেকগুলো সমস্যা আছে। অনেক পন্ডিত যেমন দেখিয়েছেন যে এই বর্ণনাটি অনেকগুলো পরিপ্রেক্ষিতগত ও ঐতিহাসিক সমস্যা উত্থাপন করে।
এ বিষয়ে হাদিসে যে সমস্যাগুলোর উল্লেখ আমরা পাই তা আওরা বিষয়ে অনেক আইনি মতামতে প্রতিফলিত হয়েছে। কোরান ও হাদিসের বিবরণের উপর দীর্ঘ বাহাসের পর, বেশিরভাগ আইনজ্ঞই এই উপসংহারে এসেছেন যে, একজন মুক্ত নারীর মুখ ও হাত ছাড়া পুরো শরীরই আওরা। অল্পসংখ্যক আইনজ্ঞ এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মুখ ও কন্ঠসহ মুক্ত নারীর পুরো শরীরই আওরা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ আইনজ্ঞ এই উপসংহারেও এসেছেন যে, দাসীর আওরা হচ্ছে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। ধ্রুপদী আইনজ্ঞদের কাছে বিষয়টা ছিল নারীদের সামাজিক অবস্থান। মুক্ত নারীরা তাদের শরীর ঢাকবেন- এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। দাসী মেয়ে বা নারীর শরীর ঢাকার এমন প্রত্যাশা ছিল না- শুধুমাত্র নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত এলাকা ছাড়া। অনেক সময় কর্মজীবি নারীদের (যেমন যারা বাজারে কাজ করে) আইনজ্ঞরা চুল খোলা রাখতে দিতেন অথবা এমন মতও দিতেন যে যে নারীদের বাইরে কাজ করতে হয়, তাদের এমন পোশাক পরা উচিৎ যা তাদের কাজের বিঘ্ন না ঘটায়।
এখান থেকে উপসংহারে আসা যায় ধ্রুপদী আইনজ্ঞদের কাছে ফিৎনা বা যৌন প্রলোভনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বরং গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক অবস্থান। বিভিন্ন ধরনের পোশাক এটাই বোঝাচ্ছে। নারীর হাত ও চুল যদি আওরা হতো, নারীটি কি মুক্ত নাকি দাসী তাতে কোনো পার্থক্য হতো না। ধ্রুপদী আইনজ্ঞদের বিশাল একটা অংশই যে নারীদের সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড তৈরী করেছেন, তা এ বিষয়টিতেই জোর দেয় যে, এ ক্ষেত্রে প্রথাগত আইন ও সামাজিক অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো ।
আমার মতে, যেহেতু( চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে) নিস্পত্তিসূচক কোনো নির্ভরযোগ্য কোনো হাদিস নাই এবং ধ্রুপদী আইনজ্ঞদের আলোচনা নারীদের সামাজিক অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে আছে, এটা আমাদের কোরানের আলোচনাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ ও অন্যসব আলোচনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য করে। উপরের আলোচনা অনুসারে, কোরান জোর দিচ্ছে শালীনতা, দৃষ্টি নত রাখা, ও জিনা দেখিয়ে না বেড়ানোর উপর। উপরন্তু, কোরান জোর দিয়ে বলছে যে নারীদের অবশ্যই নিপীড়ন থেকে নিরাপদে রাখতে হবে। আমার মতে, এই সবগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে যে এগুলো সামাজিক অভ্যাস ও সামাজিক রীতিনীতির উপরও জোর দিচ্ছে।
উপরে যেমন উল্লেখ করেছি, প্রথমদিকের মুসলমানদের ঐতিহাসিক চর্চা সমসাময়িক লেখকরা যতটা অনুমান করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বিচিত্র ও দ্যোতনাময়। যেমন, মোহাম্মদ (সঃ) মারা যাবার কিছুকাল পরে হিজাজে নারীরা জনসমক্ষে চুল ঢাকছেন না- এ রকম বিবরণ আমাদের কাছে আছে। বিবরণে আছে, নবীর বংশধর, সাকিনাহ বিনতে আল-হুসাইন বিন আলী (যিনি ফাতিমাহ আল-কুবরা নামেও পরিচিত) একটি হেয়ারস্টাইল আবিষ্কার করেছিলেন যা আল-তুরাহ আল- সুকাইনিয়াহ (সুকাইনাহ স্টাইলের কার্ল) নামে পরিচিত ছিল। এভাবে চুল বেঁধে তিনি জনসমক্ষে আসতেন। তিনি চুল ঢাকতে অসম্মত ছিলেন, এবং হিজাজের সম্ভ্রান্ত নারীরা তাকে অনুসরণ করতেন- এ রকম বিবরণ আছে।
আমি এটাও উল্লেখ করতে চাই যে, মাকারিম আল-আখলাক ( নৈতিক আচরণ ) বইয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীদের অভিমতে দেখা যায় আওরা ঢাকার বিষয়টি যতটা না শারীরিক মানদন্ড তার চেয়ে বেশি নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপার। যেমন, বলা হয়েছে আওরার হেফাজতের সাথে অন্যের গোপনীয়তা ও মর্যাদাকে সম্মান করার বিষয়টি যুক্ত, শুধু তাদের শারীরিক শুদ্ধতাকে শ্রদ্ধা করা নয়। অন্যের নামে কুৎসা রটনা করা, গীবত করা নিজেদের আওরা ভঙ্গ করা (কাসফ আল-আওরা) এবং এটা অন্যের শরীরের কোনো অংশ দেখার চেয়ে গুরুতর। এটাও ইঙ্গিত করছে যে আওরা ও জিনার বিষয়গুলোকে সমসাময়িক মুসলমানদের মতো প্রথাবদ্ধ ও যান্ত্রিকভাবে মোকাবেলা (approach) করা উচিৎ নয়। এ সময়ের মুসলমানদের উচিৎ একটা পোশাক নীতিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পালনের চেয়ে ঐ নৈতিক গুণাবলীকে উপলব্ধি ও অনুসরণ করা, যা শালীনতা, বিনম্রতা, ও মর্যাদার আকাংঙ্খার সাথে যুক্ত।
উপরের সব কথা বলার পর, আমার উপসংহার হচ্ছে এবং আল্লাহই সবচে ভালো জানেন, যদি হিজাবের কারণে নারীকে আলাদাভাবে চোখে পড়ে, যদি এটা তার প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত মনোযোগ বয়ে আনে, বা এর ফলে তাকে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে হয়- (এবং আমেরিকার সামাজিক অভ্যাস ও রীতিনীতিকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, সেখানে চুল খোলা রাখা কোনোভাবেই অশালীন ও অসচ্চরিত্র বোঝায় না)- আমেরিকায় একজন নারীর মস্তকাবরণ না পরা অনুমতিযোগ্য। আমার মতে, শুধুমাত্র চুল ঢাকার কারণে নারী নিজেকে বিপদের মুখে ফেললে তা শরীয়ার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হবে। আসলেই, নারীর জন্য অনেক বেশি শরীয়াসম্মত কাজ হবে আশেপাশের লোকজনদের ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়ে জানানোর উপর অধিকতর জোর দেওয়া, নিজের শারীরিক উপস্থিতির উপর মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, এটা খুবই আয়রনিক যে আধুনিক যুগে হিজাব ইসলামি পরিচয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে কিছু খৃস্টান ও ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মস্তকাবরণের প্রচলন পাওয়া যায় এবং ঐ ঐতিহ্যগুলোর যে ভাষিক নির্দেশসমূহ এটাকে অনুমোদন করে তা ইসলাম ধর্মে যা আছে তার চেয়ে অনেক পরিষ্কার ও নিষ্পত্তিসূচক। এটা খুবই আয়রনিক যে আধুনিক মুসলমানরা, অন্তত গত সত্তুর দশকের শেষ দিক থেকে, মস্তকাবরণকে তাদের পরিচয়ের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসাবে বেছে নিয়েছেন, যদিও এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব শাস্ত্রীয় নির্দেশ ইহুদি ও খৃষ্টানদের চেয়ে অনেক কম নিষ্পত্তিসূচক। হিজাব ইসলামের সাথে অনন্যভাবে জড়িত না। তবে এটা সত্য যে গত সত্তুর দশকের শেষ দিক থেকে ইসলামী সামাজিক আন্দোলনগুলো এটিকে ইসমালিক ক্যাটাকিজমের (catechism) অংশ বানিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মতে, বিনম্রতা, শালীনতা ও ব্যক্তিগত ধার্মিকতা / ভক্তি আল্লাহর চোখে অধিকতর মূল্যবান- যেকোনো আনুষ্ঠানিক পোশাকের চাইতে, সেটা যত পবিত্র দেখাক না কেন!
এবং আল্লাহই ভালো জানেন।
#
[ অনুবাদকের নোটঃ
১। ফাদল কোরানের যে অনুবাদ ব্যাবহার করছেন সেখানে পাচ্ছি “guard their modesty”। আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলির অনুবাদও একই। কিন্তু সহি ইন্টারন্যাশনালের অনুবাদে পাচ্ছি “guard their private parts”।
২। এখানে ‘জিনা’ বলতে অলংকার বোঝাচ্ছে। এটা বলে রাখছি কারণ ‘জিনা’ বলতে বাংলায় প্রধানত ‘ব্যভিচার’ বোঝায়।
৩। আমি বাংলা অনুবাদে পাচ্ছি “মোমিনদের স্ত্রীগণকে”। কিন্তু ফাদলের ইংরেজি অনুবাদ বলছে “the women believers”। ]