কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে কাজী নজরুল ইসলামকে ধুমকেতুর ১ম বর্ষ/১৩শ সংখ্যায় চিঠি দিয়ে বলেছিলেন,
‘কৃষক শ্রমিকের কথা কখনো ভেবেছ কি? একটা কথা সোজা তোমায় বলে দিচ্ছিল, যদি ওদের কথা ভাবতে না শেখ তাহলে তোমাকে দিয়ে দেশের কোনো সেবাই হবে না, প্রাণ দিলেও না। ওরাই দেশের শক্তি। ওদেরকে না জাগালে, আত্মবোধ না শেখালে তোমাদের তথাকথিত ভেদ্দর লোকেরা কিছুই করতে পারবে না। কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই।’ এই চিঠির মর্মবাণী মওলানা তাঁর রাজনীতির প্রয়োজনে প্রয়োগ করেছিলেন সারা জীবন।
মওলানা ভাসানী ছিলেন এক দীর্ঘ কর্মময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। অল্প পরিসরে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবুও সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই মহান জনদরদী নেতার জীবন ও রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু বলার চেষ্টা করবো।
তিনি আনুমানিক ১৮৮৫ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজি মোহাম্মদ শরাফৎ আলী খান এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ মজিরন বিবি। তিনি তাঁর পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। শৈশবে তাঁর ডাক নাম ছিল চেকা মিয়া।
প্রচলিত আছে যে, ছোটবেলায় মওলানা ভাসানী ইসলামী শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত তিনি ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। (যদিও দেওবন্দ মাদরাসায় এই সংক্রান্ত কোনো দলিলপত্র পাওয়া যায়নি)। সেখানে তিনি মওলানা হোসেইন আহমদ মাদানির কাছে কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। বাল্যকালে দেওবন্দের প্রভাবেই সারাজীবন তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্রতী ছিলেন।
মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯১৭ সালে। সে বছর চিত্তরঞ্জন দাশ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ময়মনসিংহে আসেন এবং এখানেই মওলানা ভাসানী তার সাহচর্যে আসেন। এরপর ১৯১৯ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং মওলানা মোহাম্মদ আলীর অনুপ্রেরণায় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন।
রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পর থেকেই জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর মন বিষিয়ে ওঠে। সে কারণেই বাংলার কৃষকদেরকে জমিদারী শোষণ থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ জন্যে অল্পদিনেই তিনি জমিদারদের রোষাণলে পতিত হন। জমিদারদের ষড়যন্ত্রে টিকতে না পেরে তিনি আসাম চলে যান। ১৯২৪ সালে আসামের ঢুবড়ী জেলার ভাসান চরে তিনি বহিরাগত বাঙালি কৃষকদের এক বিশাল সম্মেলন করেন। এই সম্মেলনের সাফল্য থেকেই লোকেরা তাঁকে ভাসানীর মওলানা নামে ডাকতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতকের বিশের দশক থেকে আসামে তার দুটি পরিচয় ছিল: একজন সাহসী কৃষক নেতা এবং একজন আধ্যাত্মিক পির। তাঁর এই দুটি পরিচয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। মওলানা ভাসানী কর্তৃক আয়োজিত প্রথম ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জ জেলার কাওয়াখালী নামক এক স্থানে। এই সম্মেলনের পর সারাদেশে মওলানা ভাসানী পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে মওলানার সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করার সত্যিকার অভিজ্ঞতা হয় আসামে। সেখানে তিনি ‘লাইনপ্রথার’ বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মার্চ ‘আসাম দিবস’ উদ্যাপন করতে যেয়ে মওলানা প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হন। জেলজীবনের সাথে এই অভিজ্ঞতায় তিনি কোনোদিনও মুষড়ে পড়েন নি।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত সিলেট গণভোটে মওলানা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় সিলেট দেশভাগের সময় পূর্ববাংলার সাথে যুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট যখন পাকিস্তান স্বাধীন হয় মওলানা তখন আসামে কারারুদ্ধ ছিলেন। সেপ্টেম্বরে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি টাঙ্গাইলে আসেন। এবং টাঙ্গাইলের সন্তোষে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আমৃত্যু এই সন্তোষেই ছিল তার আবাস। এই সন্তোষ থেকেই বাকি জীবন নেতৃত্ব দেন। পরিচালনা করেন নানামুখী কর্মকান্ড। মওলানা জমিদার-জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেছেন, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে, লড়াই করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ক্ষেপে উঠেছেন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সংগ্রাম করেছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, চেষ্টা করেছেন বিশ্বে যাতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। শিক্ষা বিস্তারের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আল আজহারের আদলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। অনাড়ম্বর, সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। বিলাসিতা সহ্য করতে পারতেন না। কোনো সরকারি পদ কোনোদিন গ্রহণ করেন নি। অসাধারণ এই অনলবর্ষী নেতা সূচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন। ৭১-এ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে তিনি ভারতে চলে যান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অবস্থান নেন। বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠনে বিশেষ উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনিই ছিলেন একমাত্র সাহসী কণ্ঠ যিনি নির্ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। সাপ্তাহিক হক কথা প্রকাশ করে স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
১৯৭৬ সাল তাঁর মৃত্যুর বছর। সে বছর মার্চ মাসে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে তিনি ফারাক্কা লং-মার্চের নেতৃত্ব দেন।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অবদানের মূল্যায়ন করতে হলে যে বিষয়টি মূখ্য হয়ে ওঠে সেটি হচ্ছে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা। ১৯৫৫ সালের ১৭ই জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হবার হুমকি দেন। ১৯৫৬ সালের ১৫ই জানুয়ারি, ’৫৭ সনে এবং ’৭০-এর নির্বাচনের আগেও দক্ষিণাঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার পর তিনি বিচ্ছিন্ন হবার হুমকি দিয়েছিলেন। প্রকাশ্য জনসভায় এই সকল হুমকি জনগণের মধ্যে স্বাধিকার বোধকে তীক্ষ্ণ করে তুলেছিল। ৭১-এর জানুয়ারি মাস থেকেই তিনি স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বিভিন্ন জনসভায় বলে বেড়াতে শুরু করেন। তাঁর বক্তৃতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁর সমর্থন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা মওলানা ভাসানী নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করি না। যেটুকু করি তাও নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন করে না, অনেকটাই গতানুগতিক। সেদিক থেকে একটি ব্যতিক্রমী স্মারক গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা দরকার। আমাদের প্রগতিশীল কর্মীরা মওলানা চর্চার দিকে এগুচ্ছেন এটা নিঃসন্দেহে একটি সুখবর। এ প্রচেষ্টা আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
স্মারক গ্রন্থটির প্রকাশনার কারণ হিসেবে সম্পাদনা কমিটি প্রধানত দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে বিপ্লবী ও বাম গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা; অন্য কারণ, জনগণের শত্রুদের মওলানাকে কুক্ষিগত করার হীন চক্রান্ত থেকে মওলানাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে সচেতন করা। দেরিতে হলেও এ বোধদয় জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
মওলানা এদেশের কমুনিস্ট রাজনীতির ব্যর্থতা ও সফলতার প্রতীক। মওলানা যত বড় হয়েছেন বাম রাজনীতি তত বড় হয়েছে। মওলানা যত ছোট হয়েছেন বাম রাজনীতি তত ছোট হয়েছে। এই বোধ ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায় স্মারক গ্রন্থটির প্রতিটি পৃষ্ঠা মওলানার প্রতি লোকদের কৃতজ্ঞতাবোধ, মনস্তাপ এবং সর্বোপরি ব্যর্থতার আহাজারিতে ভরে আছে। কোনো কোনো বাম নেতার আক্ষেপেও ‘আমরা কি কৃষক আন্দোলনে পুনর্গঠন করতে পারি না’? একই ধ্বনি।
গ্রন্থটিতে তথ্যের দিকে থেকে নতুন কোনোকিছু নেই। মওলানার জীবনের বিশেষ ঘটনাগুলো আবু নোমান খানের লেখার মধ্যেই প্রায় সবটুকু আছে। একটি প্রবন্ধ থেকে আর একটি প্রবন্ধের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে লেখকের আত্মজীবনীমূলক বিবরণীতে।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ সম্বন্ধে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক মন্তব্য করেছিলেন ‘এত ছফার রাজ্জাক’ আসল আবদুর রাজ্জাক না, এ কথার সুর ধরে আমারও বলতে ইচ্ছে করে ‘এত বামদের মওলানা’ আসল মওলানা না, এ তো মওলানার আংশিকরূপ।
সে শ্রমিক কৃষককে নিয়ে সারা জীবন ব্যস্ত থাকলেন, সংগ্রাম করলেন, তাদের পাশে থাকলেন সেই শ্রমিক, কৃষকের জবানীতে মওলানা অনুপস্থিত এই গ্রন্থে। কেউ কী বেঁচে নেই যে, বলতে পারতো তার কাছে মওলানা কিসের প্রেরণা ছিলেন? সঙ্গত কারণেই তারা অনুপস্থিত আর সেই কালব্যাধি যা কিনা বামদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এ সেই ব্যাধিরই উপসর্গ। অর্থাৎ উচ্চবর্গীয় চোখ দিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখা। উচ্চবর্গীয় কণ্ঠে জনগণের সাথে কথা বলা। উচ্চবর্গীয় চৈতন্য দিয়ে জনগণের চৈতন্যকে প্রভাবিত করা। নিম্নবর্গ চৈতন্যে এমন কোনো ধর্মবোধ নেই যা ক্ষমতা রহিত বা রাজনীতি বিবর্জিত। আদর্শ ছাড়া, রাজনীতি ছাড়া নিম্নবর্গের আন্দোলন হয় না, সেই রাজনীতির মূলে থাকে কোনো না কোনো ঈমান বা বিশ্বাস।
এই ঈমান কোত্থেকে আসে? আসে ঐ উচ্চবর্গীয় অবস্থান থেকে। অনেক আলোচনায় মওলানার ধর্মীয় সত্তার বিবরণের অধিক্য দেখি। বাম রাজনীতির সাথে মওলানার দূরত্ব ঐ জায়গাতে। আলোচকরা মনে করেন, সে প্রসঙ্গ যত কম আলোচিত হয় ততই মঙ্গল। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এই প্রসঙ্গই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
ল্যাটিন আমেরিকায় নিম্নবর্গের আন্দোলনে খ্রিস্টীয় ‘Liberation Theology’র ভূমিকার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। গৌতম ভদ্র তার ‘ইমান ও নিশান’ গ্রন্থে লোকায়ত সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন।
’৬৯-এর আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের রিহার্সেল। এই আন্দোলনে জ্বালাও, পোড়াও, ঘেরাও গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন মওলানা ভাসানি। ঊনসত্তরের আন্দোলনেই গণআদালতের বিচার কার্যের সূচনা হয়েছিল। এই আন্দোলনেই ব্যাপক জনগণ তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধেরও প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
যদি এককথায় মওলানার অবদানকে মূল্যায়ন করতে হয়, তাহলে বলা যায়- পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তির প্রশ্নকে মওলানা রাজনৈতিক কর্মসূচির শীর্ষে নিয়ে এসেছিলেন, যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরিতে খুব বিলম্ব ঘটেনি। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি পূর্ববাংলা ও বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে সবসময় প্রভাবিত করেছে।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করলে যা দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে:
১. তিনি শ্রমিক, কৃষকের শোষণ মুক্তি চেয়েছেন
২. তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন
৩. ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসনামলে তিনি সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন করেছেন
৪. ব্রিটিশ শাসনের অবসানে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন।
৫. একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক যোদ্ধা।
৬. ইসলামের সাম্যের বাণী আর কমিউনিস্ট রাজনীতির সাম্যবাদের মধ্যে তিনি কোনো বিরোধ দেখেন নি। চেষ্টা করেছেন সেতুবন্ধন তৈরি করতে। এভাবে ইসলাম আর বাম রাজনীতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে তিনি বাংলার শোষিত মানুষের প্রিয় মওলানা হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ কৃষকের কাছে তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক নেতা, তাদের ‘পীর’। আর মধ্যবিত্ত বামপন্থী কর্মীদের কাছে ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচারবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পক্ষের প্রধান রাজনীতিবিদ।
মওলানাকে নিয়ে আমরা কেন লিখবো? এ আলোচনা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে চাই? যে সময়ে মওলানা রাজনীতি করেছেন, যে কৃষক শ্রমিকের সমস্যা নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছেন সেই কৃষক, শ্রমিকের চেহারা এখন কি সেই সময়ের মত আছে? বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামো সেই সময় যেমন ছিল আজও তেমনটি আছে? সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম কি আগের জায়গায় আছে? বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কি আগের মত আছে? সর্বোপরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা কি আগের মত? আমাদের প্রতিবেশি ভারত, মিয়ানমার, চীন কি আগের শক্তি নিয়ে বিরাজ করছে? ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধাচারণের নামে তেল, খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করার যে নতুন রাজনীতি সেটা কি মওলানা দেখে গিয়েছেন? কর্পোরেট ক্যাপিটালিজম-এর যে চেহারা আমাদের মত গরীব দেশের উদ্বৃত্ত শ্রম ও উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের যে নতুন ব্যবস্থা তা কি মওলানা দেখে গেছেন? তিনি কি ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ এক কেন্দ্রিক বিশ্বের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন? এগুলোর কিছু তিনি দেখেন নি, তবে তার রাজনীতি থেকে কি শিক্ষা আমরা নেব? আমি মনে করি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেতে পারি।
সর্বপ্রথম যে শিক্ষা তিনি রেখে গেছেন সেটি হলো, যে মানুষের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন তার মাঝেই তিনি সারাজীবন থেকেছেন। সারাজীবন সন্তোষের ঐ কুড়ে ঘরে কৃষক, শ্রমিকের সাথে কথা বলে তিনি তার রাজনীতি নির্ধারণ করেছেন। তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন তারাও তার ভাষা বুঝতেন। সর্বোপরি তিনি তাঁদের চৈতন্য, তাদের অবদমিত আত্মমর্যাদাবোধ, সর্বোপরি তাদের ঈমান বা বিশ্বাসকে অনুধাবন করতে পারতেন।
আজ এই জীর্ণ সমাজকে যারা পরিবর্তন করতে চায় তাদেরকে তা বুঝতে হবে ঐ সমাজের কে বা কারা পরিবর্তন চায়। আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে সাইক্লিক্যাল মোবিলিটি (ঘূর্ণায়মান ওঠানামা) তীব্রতর হচ্ছে?। কিন্তু ডিফারেন্সসিয়াসন্স/পার্থক্য হচ্ছে না বা সমাজ দুইভাগে ভাগ হয়ে স্থির হচ্ছে না। বিশ্বায়নের ফলে সমাজে শ্রেণি উত্তরণের সুযোগ বেড়ে গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা, শ্রমের বাজারের বিস্তৃতি, নতুন প্রযুক্তি সর্বোপরি তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব। আর সেই সাথে জনগণের ওপর শোষকের প্রায় ঐশ্বরিক নজরদারী। আরো আছে দমন পীড়নের নয়া কৌশল।
এই প্রেক্ষিতে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি কী হবে? সেটা মওলানার পথ ধরে শোষিত মানুষের পাশে থেকে জানতে হবে। সকল প্রকার রাষ্ট্রযন্ত্র আজ এক দানবীয় চেহারা নিয়েছে। তারা আজ জবাবদিহিতার বাইরে। সম্প্রতি দুদকের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার আইন পাস হয়েছে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন সব জনগণের বিরুদ্ধে একাট্টা।
রাষ্ট্রের অধিপতি কি কোনো শ্রেণি? না সামরিক/বেসামরিক আমলারা? ’৪৭-এর পর এ পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিকানার কত অংশ আমলাদের দখলে গেছে?
আজ জাতীয় বুর্জোয়া কারা? শ্রমিক শ্রেণির চরিত্র কি? জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কিভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? সীমানা দিয়ে না বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে? স্বাধীনতা ও সার্বভোমত্বের সম্পর্ক কি?
মওলানা স্বাধীনতার পরই সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলেছেন। ফারাক্কা মার্চের (১৯৭৬) মধ্য দিয়ে সেটি স্পষ্ট হয়েছে।
ইসলাম বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, কিন্তু সেই ধর্মের প্রকৃতি কি? সবাই কি একই ইসলাম অনুসরণ করে? বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে ইসলামের চেহারা কিভাবে পাল্টাচ্ছে? মওলানার ইসলামের সাথে তার পার্থক্য কি? মওলানার ইসলামের সাথে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির সম্পর্ক কি হবে? এগুলো সবই আজকের এজেন্ডা। এ আলোচনায় মীমাংসা না করে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি এগুবে না।
সর্বোপরি সমাজে যতদিন শোষণ থাকবে যতদিন অন্যায় থাকবে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ততদিন চলবে। সেই সংগ্রামকে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া চালু থাকতে হবে। সেই খাপ খাওয়ানোর শিক্ষা মওলানা দিয়েছেন। সেই শিক্ষা নিতে হবে জনগণের কাছ থেকে।
আজ কৃষক আন্দোলন নেই, কৃষক সংগঠন নেই, তবুও সামাজিক ন্যায় বিচারের আকাঙ্খা তীব্রতর হচ্ছে।
মনে রাখলে ভাল হয়, যে ট্রেন ছেড়ে গেছে, সেই ট্রেন ধরার জন্য পেছনের স্টেশনের দিকে না দৌঁড়ে, সামনে স্টেশনের দিকে দৌঁড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ।