[লোকায়ত প্রণীত এই আদবনামাটি একটি খসড়া দলিল মাত্র। এতে যোজন-বিয়োজন ঘটবে।]
১/ সফর নিশ্চল-নিত্য কোনো ঘটনা নয়। প্রেক্ষিত ভেদে এর আছে ঐতিহাসিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-দার্শনিকসহ নানান অবয়ব।
২/ শুধু যে মানুষই যে সফর করে তা নয়, মানুষ-ভিন্ন অন্য সত্তাও, যেমন নানা প্রকার প্রাণ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীও সফর করে। মানুষ-ভিন্ন অন্য সত্তাদের ভ্রমণ ঘটে প্ল্যানেটারি স্কেলে, ঘটে গাছের পরাগায়নের মধ্য দিয়ে। মানুষের সফরের কারণে মানুষ-ভিন্ন অন্য সত্তাদের সফরের নকশা-রীতি বদলে যায়, বিস্থাপিত (displaced) হয় (পুঁজিবাদ, বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক আধুনিকায়নের কারণে)।
৩/ মানুষের সফর নানান কালে নানান কারণ থেকে হয়, তীর্থ যাত্রা থেকে হাল আমলের পর্যটন শিল্প।
৪/ মানুষ যখন সফর করে তখন সে তার মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে সফর করে। সেই সাথে মানুষ তার ঔপনিবেশিকতাসঞ্জাত পরিচয়ের দাপট ও ভেদাভেদমূলক বন্ধুত্বের ধারণা নিয়েও যায়।
৫/ সকল সফর পর্যটন নয়। পর্যটনশিল্প ঔপনিবেশিক আধুনিক কালের ঘটনা। এটি চলে ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী বিশ্ববীক্ষার ভিত্তিতে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্যে। পর্যটন একটা ক্ষমতার নাম, একটা ক্ষমতা সম্পর্কের নাম।
এতক্ষন বলা সব দিক মিলায়ে বলা যায়,
৬/ সফর কোনো নিরীহ ঘটনা বা প্রক্রিয়া নয়।
১/ সফর হবে রূপান্তরের জন্য। রূপান্তর বলতে বর্ণবাদ-ঔপনিবেশিক-আধুনিকতার বাইরে, নরকেন্দ্রীকতামুক্ত, শ্রেষ্ঠত্ববাদমুক্ত, পুরুষতান্ত্রিকতামুক্ত, নির্বিকার ভোগবাদমুক্ত, পরিচয়বাদমুক্ত, দরদী সত্তা হিসেবে নিজেদের নির্মাণ/রচনা করতে থাকা।
২/ গতানুগতিক সফরে যে স্বাভাবিকীকৃত জুলুম থাকে সেটা বুঝে ও বাদ দিয়ে নতুন ধরনের সফরের কল্পনা করতে হবে।
৩/ বিউপনিবেশিক চিন্তাপ্রস্থান ও প্রস্তাবনার মাধ্যমে নতুন ধরনের সফরের কল্পনা করা।
জাতি-পরিচয়ভিত্তিক রাষ্ট্রের সমাজে বৈষম্যকারী ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে সংখ্যাগুরু কিংবা অধিপতি পরিচয়ধারী মানুষের সফরে চলমান পরিচয়ভিত্তিক আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক, সাংস্কৃতিক জুলুম জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে ব্যবহার ও পুনরুৎপাদন হতে পারে, হয়।
বিশেষ করে আধুনিক জাতি-পরিচয় রাষ্ট্র ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক যে সীমানাব্যবস্থা ভিত্তি করে গঠিত ও চলমান, তা সাম্রাজ্যিক, ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী। এমন সীমানাব্যবস্থায় আদিবাসীসহ নানান জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জীবনপ্রণালী, জাতি-পরিচয় রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌমত্ব’, ‘নিরাপত্তা’ ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। অবিবেচক সফরে অধিপতির দিক থেকে এই প্রাতিষ্ঠানিকতার জুলুমের সুবিধা নেয়া হয়।
বিশেষ করে জাতি-পরিচয় রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু/অধিপতির ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক-অ প্রাতিষ্ঠানিক দাপটের ব্যবহার ‘স্বাভাবিকীকৃত’। ভাষাভিত্তিক জাতি/পরিচয় রাষ্ট্রে এই দাপট ভিন্ন সব ভাষাগোষ্ঠীর ‘অপর’করণে ভূমিকা রাখে। সফরকারীর ভাষা, সফরের ভাষা, যোগাযোগের ভাষা- সবই এই ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে পড়ে।
জগতের বুঝ এবং বুঝের জগত, জ্ঞানের জগত এবং জগতের জ্ঞান গত ৫শ’ বছরে গভীর বর্ণবাদী ঔপনিবেশিকতা দিয়ে সজ্জিত ও নির্মিত, পর্যটনের মতো আধুনিক শিল্পও তার বাইরে থেকে জগত দেখেনা। যেমন, ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী বুঝ অনুযায়ী- ক) সফরকারী ‘অপর’ তৈরী করে; খ) সফরের সাথে যে জোড়বিপরীত (binary) গুলো পুনরুৎপাদিত হয়, যেমন সভ্য/অসভ্য, শহর/গ্রাম, কাজ/জীবন, জীবন/পেশা; উদাহারনস্বরূপ, শহর হচ্ছে কাজের জায়গা, গতির জায়গা; শহর হতে হবে আধুনিক; শহরবাসী যেখানে সফর করবে সেটা হতে হবে ‘প্রাকৃতিক’, সেখানকার মানুষগুলো হতে হবে ‘প্রিমিটিভ’, ‘সহজ-সরল’; ভাবা হয় যে এখানে সময় ‘থেমে থাকে’। গ) ঔপনিবেশিক আধুনিক পর্যটনশিল্পের সাধারণ ঘটনা হলো অদ্ভুতিকরণ (exotification) ও ভোগ্যকরণ, যার মাধ্যমে মানুষ এবং জগতের অন্য সকল সত্তার উপর সহিংসতা ও ত্রস্ততা করা হয়।
এসবই ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী জগত বুঝ, ব্যাখা ও রচনার উদাহরণ।
পর্যটন শিল্প এই ঔপনিবেশিক জ্ঞানব্যবস্থার ব্যবহার ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে জুলুম জারী রাখে। বর্তমান দুনিয়া ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী-পুজিবাদ ভিত্তিক দুনিয়া। পর্যটনশিল্প এই ভিত্তিতেই বিকশিত। ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পর্যটনশিল্প আরও বহুরকম সহিংসতা তৈরী করে, যেমন: নানারকম বিস্থাপন (displacement), প্রতিবেশগত বিপর্যয়।
১/ যেখানে যাব, যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাব, তা নিয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা।
সফরে নানা কিছুতে প্রবেশগম্যতা(access) কোন ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আদান-প্রদান হয়, সম্পর্কের উভয় প্রান্তে সফর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া- সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব কেমন হয়- ন্যায়-ইনসাফি হয় কি না- সেসব খুব জরুরী বিবেচনার দিক ।
২/ নিজের ক্ষমতা-অবস্থান (positionality) সম্পর্কে সচেতন থাকা। নিজের কায়েমি সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে অবগত থাকা। নিজের ক্ষমতার জুলুমকারী চর্চা থেকে বিরত থাকা।
৩/ সফরকে নিজের এবং জগতের রূপান্তরের উপায়, উপলক্ষ্য, সুযোগ এবং প্রক্রিয়া হিসাবে চর্চা করা। রূপান্তরের উদ্দেশ্য নিয়ে সফর করা, সে মতে সফরের খুঁটিনাটি ঠিক করা।
৪/ বিভিন্ন সমাজ সম্পর্কে বর্ণবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ না করা।
৫/ ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী বিশ্ববীক্ষার বাইরে সফর, যাতায়াত, ভ্রমণ এবং ‘পর্যটন’কে কল্পনা এবং অনুশীলন করা, যেখানে ইতোমধ্যে স্বাভাবিকীকৃত হয়ে যাওয়া সহিংসতাগুলো হবে না। এই নতুন সফর মানুষ-প্রকৃতি দ্বি-বিভাজন করবে না। ‘মানুষ’ এবং ‘প্রকৃতি’কে অদ্ভুতিকরণ(exoticise) ও ভোগ্যকরণ করবে না, দখল বা ভোগের বস্তু বানাবে না।
৬/ মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং সংহতি রচনার উপায় ও মাধ্যম হিসাবে সফর চর্চা করা। এটা করতে দরকার কায়েমী সুবিধা (প্রিভিলেজ) সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া, নিজের আচার-আচরণ, সামাজিক অনুশীলন, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্ববীক্ষা সবকিছুর পর্যালোচনা করা। নতুন, ন্যায়-ইনসাফি, রূপান্তরমূলক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চর্চা করা।