[মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৪ তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে ১৭ নভেম্বর, ২০২০-এ “লোকায়ত বিদ্যালয়”-এর আয়োজিত “ভাসানী স্মরণ” অনুষ্ঠানে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লাইলি উদ্দিন ও আহমেদ কামাল গুরুত্বপূর্ণ আলাপ রাখেন। এটি সেই আলাপের আহমেদ কামালের যে অংশ, সেটার শ্রুতিলিখন। আহমেদ কামাল একজন ইতিহাসবিদ। তিনি লোকায়ত বিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত আছেন। তাঁর লেখাপত্রের মধ্যে ‘কালের কল্লোল’ ও ‘স্টেট অ্যাগেইনস্ট দ্যা নেশন ’ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘খাতির আলীর লাল সুর্য’।
শ্রুতিলিখনের কাজটি করেছেন ফাহিম আলম । লেখাটি সম্পাদনা করেছেন মোহাইমিন লায়েছ।]
আমি সমাজ পরিবর্তনের দিশা দেয় না এমন কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে রাজি না এবং কোনো বিষয়ে লেখাপড়া করতেও রাজি না। অতএব, আমার আলোচনার আজকের উদ্দেশ্য হচ্ছে মওলানা ভাসানীর আলোচনা আমরা কেন করবো সেটা। এই আলোচনা মুখ্যত যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছেন সেই সকল কর্মীদের জন্যেই করতে চাই। আমার মতো করে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আমিও ছাত্রজীবন থেকে করেছি, কিন্তু কতটা সমাজ পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি জানি না। তবে সেই স্বপ্নটা, সেই চেষ্টাটা এখনো বর্তমান আছে। সেজন্যই আমি আমার সব আলোচনাকে সমাজ পরিবর্তনের জন্যই করতে চাই।
৪৪ বছর হয়ে গেলো মওলানা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। একজন মৃত লোক, বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসে যার জায়গা ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে সচেষ্ট ভাবে, সেই মানুষটাকে নিয়ে আমরা কেন আলোচনা করবো?
একটা জায়গায়ই মওলানা ভাসানী সারাজীবন টিকে থাকবেন। সেটি হচ্ছে যতদিন এই সমাজে শোষণ থাকবে, অত্যাচার থাকবে- ততদিন মওলানা ভাসানীর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এটা কেউই সরাতে পারবে না।
যারা ইতিহাস থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়, এই সরিয়ে দেয়ার মধ্যে কিন্তু তাদের ইতিহাসটা খুব স্পষ্ট হয়- প্রমাণ হয় তারা কারা। তারা কেন মওলানাকে অপছন্দ করেন, কেন মওলানাকে তারা তাদের ইতিহাসের মধ্যে জায়গা দিতে চান না। একটিই কারণ, মওলানা যাদেরকে সারাজীবন ঘৃণা করেছেন, যাদের বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন- সেই আধা সামন্তবাদী, বিদেশী পুঁজি নির্ভর বুর্জোয়া, এই দেশের আমলা এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ- এই শ্রেণীটি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে স্বাভাবিকভাবেই মওলানার ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা তারা বোধ করবেন না বটেই, বরং তারা সে ইতিহাসটাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এই মুছে দেওয়ার মধ্যেই কিন্তু মওলানার ইতিহাস আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আমরা দীপেশ চক্রবর্তীর ‘পাট- শ্রমিকের ইতিহাস’ থেকে একটা কথা জেনেছি- এদের কেন ইতিহাস থাকে না, কারণ এই ইতিহাস হচ্ছে ক্ষমতার প্রশ্ন। ক্ষমতার জায়গায় এরা যত নিচে থাকে ততই এদের ইতিহাসের দলিল ও ইতিহাসের জায়গা পাওয়ার চেষ্টা অনেকখানি কম থাকে। আমরা মওলানাকে সেই ইতিহাসের সামনে নিয়ে আসতে চাই।
এই ইতিহাসকে কারা সামনে নিয়ে আসবেন?
যারা এই সমাজের পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, যারা ঐ শ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন, কৃষক-মজুরের জন্য সাম্য- ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন- তারাই মওলানাকে ইতিহাসের পেছন থেকে আবার সামনে নিয়ে আসবেন। তাদের রাজনীতিতে তারা যতটা সামনে আসতে পারবেন এদেশের ইতিহাসে মওলানা অতোটাই সামনে আসতে পারবেন। এটা আমরা যারা সমাজ পরিবর্তন চাই তারা যদি মনে রাখি তাহলে মওলানার প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়। সে দায়িত্বটা হচ্ছে মওলানাকে বোঝা, মওলানাকে বুঝতে পারলেই আমরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারব।
মওলানার রাজনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো কী, সেগুলো যদি আমরা বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে আমরা মওলানাকে বুঝতে পারব। সেই বৈশিষ্ট্যেগুলোর মধ্যে প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মওলানা সারাজীবন শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির রাজনীতি করেছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেন- [এ ব্যাপারে] আনকম্প্রোমাইজিং। কখনই তিনি এর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে চান নাই। এমনকি নিজের প্রাণ প্রিয় দল যেটা তিনি গড়েছিলেন- সে দলকেও তিনি ভেঙে ফেললেন ১৯৫৭ সালে, যেহেতু তারা সাম্রাজ্যবাদের সাথে সমঝোতা করেছিল। মওলানা উপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন। মওলানা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন করেছেন, স্বাধিকার আন্দোলন করেছেন। এমনকি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।
মওলানা একটি অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরী করতে চেয়েছেন। এই বিশাল রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের পাশে তাঁর আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিল- যে বৈশিষ্ট্য তাঁকে মূলধারার রাজনীতি থেকে আলাদা করে এবং জনগণের কাছে নিয়ে যায়- সেটি হচ্ছে তিনি ইসলামের সাম্য এবং কমিউনিস্ট রাজনীতির সাম্যের মধ্যে কোনো বিভেদ দেখেন নাই। এই জায়গাটাই তিনি যাদের সাথে আগে রাজনীতি করেছেন- মুসলিমলীগ ও আওয়ামীলীগ- তাদের সাথে মওলানার পার্থক্য সূচিত করেছে। এমন সময়ে তিনি এই সংগঠনগুলির ঐক্যের কথা ও তাদের নিয়ে কাজ করতে বলতেন, যে সময় সারা রাষ্ট্র ছিল কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে ভীত।
আমার গবেষণার কাজের সূত্রে ‘৪৭ থেকে ‘৭০ পর্যন্ত সরকারি নথিপত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে [নথিপত্রে দেখা যায়] কমিউনিস্ট ভীতি এমন ভাবে পেয়ে বসছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে, যেকোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে পাকিস্তান রাষ্ট্র কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করছেন এবং তাকে দমানোর চেষ্টা করছেন। এই ভীতি কিন্তু তারা [পাকিস্তান রাষ্ট্র] আবিষ্কার করে নাই। সেইসব ডকুমেন্ট দেখলে বুঝা যায় যে, রুশ বিপ্লবের পর থেকেই ব্রিটিশ কলোনিয়াল রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেও এই ভীতি ছড়িয়ে আছে- আর পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল তার উত্তরাধিকারী। এই সাহসী অবস্থান নেয়া একমাত্র মওলানার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
তিনি এই সাম্যের কথা কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে বা তাদের আয়ত্তে [থেকে] বলেন নাই, তিনি ইসলামের সাম্যের মধ্যে দিয়েই কমিউনিস্ট সাম্যের কথা প্রচার করেছেন। আমরা দেখতে পাই এরই সাথে তিনি বিশ্ব শান্তির প্রবক্তাও ছিলেন। মওলানা যত বড় হয়েছে এ দেশের বাম আন্দোলন অতোটাই বড় হয়েছে। মওলানাকে যখন ছোট করা হয়েছে এ দেশের বাম আন্দোলন ততটাই ছোট হয়েছে। এটি আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে।
মওলানাকে ছাড়া এ দেশের রাজনীতিতে এগোনো আমাদের জন্য এখন একদম অসম্ভব। আজকে যে সকল বামপন্থীরা মওলানার মৃত্যু দিবস উৎযাপন করছেন। এদের অনেকেই একসময় মওলানাকে নিয়ে নানারকম বিরূপ সমালোচনা করেছেন, সাম্প্রদায়িক বলেছেন, মৌলবাদী বলেছেন, কেউ কেউ তাকে ভারতের এজেন্ট বলেছেন। নানা ধরণের রাজনীতির প্রেক্ষিতে তাকে নানা ধরণের নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরণের কুৎসা রচনা করা হয়েছে; কিন্তু মওলানাকে তারা কখনোই তাদের ঐ কুৎসার মধ্যে আটকে রাখতে পারেন নাই, কারণ মওলানা অত্যন্ত সৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন। সারাজীবন তিনি ক্ষমতার বাইরে থেকেছেন, জনগণের মধ্যে সারাজীবন থেকেছেন, সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণভাবে বাস করেছেন।
মওলানাই একমাত্র বাংলাদেশের নেতা যিনি তার প্রত্যেকটি জনসভায়, (আমার জীবনকালে মওলানার সবগুলি জনসভায় আমি অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম) তাঁর বক্তৃতার একটা অন্যতম অংশ থাকত সেই দিনের বাজারদর। এই যে গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, এটা সম্ভব ছিলো কারণ ঐ গ্রামের মধ্যে তিনি সারাজীবন থেকেছেন।
মওলানা নিজে মাঠে চাষাবাদ করতে পারতেন। আমি যখন প্রথম তার সাথে দেখা করতে যাই ৭২ সালে, একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদের সঙ্গে তারই গরজে; তখন তিনি মাঠের মধ্যে লুঙ্গি পরে মাটি খুচাচ্ছেন। দূর থেকে তাঁর এক সাহাবী তাঁকে বললো যে, “ভারত থেকে একজন মেহমান আসছে”। উনি ঐখানে হাত দিয়ে বললেন- “ওনাকে বসিয়ে খাওয়াও, আমি আসতেছি। এই কাজটা শেষ করেই আসতেছি”। মওলানা কাঁচি হাতে ঐভাবে এসে ঘরে ঢুকলেন এবং আমাদের সাথে আলাপে বসলেন। এই যে মওলানা, এই মওলানার এই যে চরিত্র, এই চরিত্র আমাদের বুর্জোয়া কোনো নেতাদের কারোর মধ্যে থাকার কথা না। সাধারণ মানুষ মওলানার এই চরিত্রকে ভালো না বেসেও পারে না। এ দেশের সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালবেসেছে এবং এই ভালবাসার জন্য সাধারণ মানুষ তার ডাকে সবসময় সাড়া দিয়েছে।
আমরা তো তার বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝলাম। এখন যেই বাংলাদেশে মওলানা রাজনীতি গড়েছেন সেই বাংলাদেশ কি এখন আছে? সেই শ্রমিক, সেই কৃষক- এদের চেহারা পাল্টে গেছে অনেক। বিদেশ যাওয়ার সুযোগে, বিদেশী টাকায়, বিভিন্ন সাহায্যের টাকায়, মাইক্রো ক্রেডিট ইত্যাদি নানা ধরণের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে কৃষকের অনেক বেশি শ্রেণী উত্তরণ হচ্ছে। মওলানা যে কৃষক দেখে গেছেন এখন আর সে কৃষক নাই। কৃষক এখন স্বপ্ন দেখে তাঁর সন্তান কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যাবে, কৃষক স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘরটা কিভাবে পাকা করা যায়, কৃষক স্বপ্ন দেখে তাঁর মেয়ের বিয়েতে সে একটা মোটর সাইকেল দিতে পারবে কি পারবে না। এই যে অর্থের আগমন- প্রতিটা কৃষকের হাতে এখন মোবাইল ফোন, এই কৃষক আর আগের কৃষক নাই। শ্রমিকও আর আগের শ্রমিক নাই, কারণ এখন উৎপাদন খাতে যে শ্রমিক তৈরী হয়, সে উৎপাদন খাতটা এখন প্রায় বন্ধ। আমরা এখন গার্মেন্টসে সব থেকে বেশি কাজ পাই অর্থাৎ বিদেশের কাজ আমরা নিয়ে আমরা তাদেরকে সস্তা শ্রম দেই এবং আজকের লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক সেই কাজের মধ্যে জড়িত। মওলানার সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী শ্রমিক ছিল না। ফলে আজকে শ্রমিকের ও কৃষকের চেহারাও পাল্টে যাচ্ছে।
মওলানার যে মূল বিষয় সেটি হচ্ছে তাঁদের ভাষায় কথা বলা, তাঁদের ভাষা শেখা। তাঁদের ভাষাটাকে সমাজ পরিবর্তনকামী মধ্যবিত্তের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু সে জায়গাটায় না যেতে পারলে আমরা এই কৃষক, এই শ্রমিক, এই মধ্যবিত্ত কী চাচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায় নাই।
আসলে সমাজ পরিবর্তন কে চায়, এটা আমাকে প্রথমে জানতে হবে। কেন চায় সেটাও জানতে হবে।
সেটা জানতে পারলেই তাঁদের ভাষায় কথা বলা আমাদের চেষ্টা করতে হবে, এই চেষ্টা করতে হলে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের সাথে কথা বলতে হবে। তাঁদের সাথে কথা না বলে, ঢাকা শহরে অবস্থান করে আমরা সমাজ পরিবর্তনের জন্যে নানারকম চেষ্টা-চরিত্র করলাম, তাতে সমাজ পরিবর্তন হয় না।
১৯২১ সালে এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছে- এখন পর্যন্ত সমাজের মধ্যে তার ইমপ্যাক্ট তেমন একটা পড়ে নাই। কারণ ঐ মধ্যবিত্ত যেই ভাষায় কথা বলেছে, যেই ভাষায় তারা এই জ্ঞানটা লাভ করেছে, যে ভাষায় তারা চিন্তা করেছে- সে ভাষার সাথে বাংলাদেশের গরিব মুসলমান কৃষক জনতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফলে একমাত্র মওলানাই শতকরা ৯০ জন লোকের ধর্ম বিশ্বাসকে আহত না করে সাম্যের কথা বলতে পেরেছিলেন এবং সে কথা মানুষ শুনত।
মওলানার যে রাজনৈতিক শিক্ষা তার মধ্যে কতগুলি মূল জিনিস আমাদেরকে শিখতে হবে। ব্রিটিশদের ট্রেনিং প্রাপ্ত এদেশের মধ্যবিত্তের নিয়মতান্ত্রিক যে রাজনীতি, মওলানাই প্রথম সেই রাজনীতিকে ভেঙ্গে দেন এবং ‘৬৯-এর ‘জ্বালাও পোড়াও ঘেরাও’ আন্দোলন সূচনা করে গ্রামে তিনি রাজনীতিকে ছড়িয়ে দেন। আগের সব আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরগুলি। ‘৬৯-এর আন্দোলনেই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। শুধু ছড়িয়ে পড়া না, ‘সহিংস রূপ’ এবং ‘গণআন্দোলন’- জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দুটি ফর্ম ইন্ট্রোডিউসড হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং এই ‘৬৯-এর আন্দোলনে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সীমানা মওলানা ভাসানী ভেঙে দেন। যে কারণে তাকে সাম্রাজ্যবাদী পত্রপত্রিকায় ‘Prophet of Violence’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মওলানা এই যে সীমানা ভাঙলেন সেটা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের, স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা রিহার্সেল। সেই রিহার্সেল মওলানার নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে এই রাজনীতির নতুন মোড় নেয়া হলো।
রাজনীতি যে সহিংস হতে পারে তার যে শিক্ষা সেই শান্তিপ্রিয় মুসলমান কৃষকদের জীবনে হলো, সে শিক্ষার ফলেই ৭১-এর যুদ্ধে তাঁরা পাক সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করতে সাহসী হয়েছিল এবং যুদ্ধ করেছিল। এই জায়গাটা আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এই দেশের রাজনীতিতে শত্রুকে কাবু করার জন্যে সহিংস হতে হলে হতে হবে। এইখানে মওলানা অহিংস রাজনীতি করতে চান নাই।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাসের অন্তর্গত মওলানা নিজেও। তিনি পীর হিসেবেও পরিচিত, মানুষকে তিনি পানি পড়া দিতেন, পীর হিসেবে মানুষ তাঁর কাছে যা আশা করতো তিনি সে আশা পূরণ করতেন। সেই সাথে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রের যে কাঠামো, আধুনিক রাষ্ট্রের অত্যাচারী সংগঠনগুলি তাদের কাছে তুলে ধরতেন। যে কৃষক রাষ্ট্রকে বুঝতে পারত না, রাষ্ট্র তাঁর থেকে অনেক দূরে; রাষ্ট্র বুঝতে পারত না বলেই তো মওলানা পীর। পীরের মাধ্যমেই রাষ্ট্র সম্পর্কে জানতে হয়; [ এমন সমাজে] যেমন আল্লাহকে জানতে হয় পীরের মাধ্যমে, পীরের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়।
মওলানার পীরের এই দুইটা দিক ছিলো- রাষ্ট্রকে সাধারণ মানুষের সাথে পরিচয় করানোর দিক এবং আরেকটা হলো আল্লাহর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় করানোর দিক। মওলানা তাঁর পীরত্বের এ দুটি দিক সফলভাবে পালন করতে পেরেছিলেন। অতএব, আজকে যারা সমাজ পরিবর্তন চায় তারা পীর হতে পারবেন না। তাদের পীর হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো- এটা ইউজফুল হবে না।
এই রাষ্ট্রের যে সহিংস চরিত্র, রাষ্ট্র কী, রাষ্ট্র কিভাবে শোষণ করে, রাষ্ট্র কিভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে, আমাদের জীবনের শোষণের জায়গায় আসে এবং আমাদেরকে অন্যের হাতে তুলে দেয়, আমাদের সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দেয়, আমাদের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে- সেই রাষ্ট্রকে পরিচয় করানোর দায়িত্ব হচ্ছে এই সমাজ পরিবর্তনকারী কর্মীদের। আমি বামপন্থী কর্মীদের কথা বলছি না। কারণ বামপন্থী কর্মীরা কারা সমাজ পরিবর্তন চায় আর কারা চায় না তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারি নাই। আমি বলছি যারা চায় সমাজ পরিবর্তন করতে তাদের জন্যে আমার এই বক্তব্য।
মওলানার যে সার্বভৌমত্বের রাজনীতি সেটি তিনি ফারাক্কা মার্চের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন। সেই মার্চে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই হাজার হাজার লোক যখন রাজশাহী থেকে কানসাটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তখন মওলানার শরীর ভালো ছিলো না, কিন্তু সেই অবস্থাতেও পুরো মিছিলটা যাতে শৃঙ্খলার সাথে হয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে কিনা সেটি তিনি সবসময় খেয়াল করছিলেন। এই মিছিল নিয়ে তিনি কানসাটে গেলেন এবং সেখানে তিনি ইন্দিরা গান্ধির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিলেন। ওখানে সঞ্জয় গান্ধী এসছিলো- তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরুর সাথে তার বন্ধুত্ব এবং ভারতের কাছ থেকে আমরা কী আশা করি এইসব বলে তিনি পানির দাবিটা খুব স্পষ্ট করে তুললেন।
এই যে স্বার্বভৌমত্বের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ, এই লড়াইয়ে ও রাজনৈতিক সংগ্রামে জনগণের অংশগ্রহণ, সেই অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা, সংগঠিত করা- এইটা একমাত্র মওলানাই করতে পেরেছিলেন। এটি আমাদের জন্য একটা বিরাট শিক্ষা। যারা সমাজ পরিবর্তন চায় তাদেরকে ভাবতে হবে তাদের এই সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে আজকে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। সেই প্রশ্নটাকে মোকাবেলার জন্য এই মানুষগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সেই প্রশ্নটাকে এড্রেস করতে হবে, প্রশ্নটাকে মোকাবেলা করতে হবে। অতএব যারা সমাজ পরিবর্তন চায় তাদের জন্য মওলানার এই ফর্ম, আন্দোলনের এই ফর্ম অবশ্য গ্রহণীয়।
জীবিত মওলানাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি নাই। কিন্তু মৃত মওলানাকে আমাদের সংগ্রামে দিশারী হিসেবে সামনে রাখতে পারি সেই চেষ্টা আমাদের থাকতে হবে। কারণ যে ট্রেন ছেড়ে যায় তার জন্য পেছনের স্টেশনে দৌড়িয়ে লাভ নাই। সেই ট্রেন ধরতে হলে সামনে দৌড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদেরকে মওলানার কাছে যাওয়ার জন্য আরও দ্রুত পদক্ষেপে রাজনীতিকে গ্রহণ করতে হবে এবং রাজনীতি চর্চা করতে হবে।
ইতিহাসে আমরা যারা সমাজ পরিবর্তন চাই, তাদের হেরে যাওয়ার গল্পটা বারে বারে বলতে হবে। মওলানার শুধু মৃত্যুদিন আর জন্মদিন আলোচনা করলে চলবে না, তাঁর জীবন নিয়ে আমাদের বারে বারে আলোচনা করতে হবে। এই আলোচনার মধ্যেই জনগণের যে রাজনীতি, যে ভাষা- সেটা আরো সুস্পষ্টভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাবে। এই হারার কাহিনিটা বারে বারে না বললে হবে না। শোষক শ্রেণী কিন্তু চাইবে আমরা এই পরাজয়ের কাহিনীটা যেন ভুলে যাই, পরাজয়ের কাহিনীটা ভুললেই আমরা আর বিজয়ের কথা মাথার মধ্যে রাখতে পারব না। ফলে আমরা এই কাহিনীটা বারে বারে বলব যে মওলানা হেরে গেছেন, আমরা হেরে গেছি। কেনো আমরা হেরেছি, কী জন্যে হেরেছি এইটা বারে বারে না বললে বিজয়ের রাস্তাটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে না।