[খসড়া মাত্র। কোনো চূড়ান্ত বক্তব্য নয়। সমাজে শ্রদ্ধাপূর্ণ আলাপ-পর্যালোচনা চর্চার চেষ্টার অংশ হিসেবে পঠিতব্য। শ্রদ্ধাপূর্ণ মতামত কাম্য। যোজন-বিয়োজন চলবে।]
ক) এই আন্দোলনে যারা নানান পরিসর এবং মঞ্চে সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যে কিছু ‘বাম’/’সেক্যুলার’/’প্রগতিশীল’ বাদে ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’ বনাম ‘ইসলামি জাতিবাদ/পরিচয়বাদ’- এই জোড়-বিপরীতের(=বাইনারীর) বাইরে যাবার প্রচেষ্টা দেখা যায়নি।
খ) ‘বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিরোধী’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী’ ও ‘স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি’ রেটরিক দিয়ে যেভাবে ‘ইসলামি ভাবধারা/পরিচয় ভিত্তিক’ রাজনীতির বিভিন্ন পক্ষকে সবসময় চিহ্নিত করা হয়ে আসছে এবারো সেই চর্চা লক্ষ্য করা গেছে। তেমনি, নানা পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরিসর ও মঞ্চে ‘ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক’ রাজনীতির ‘বাইরের’ ভিন্নমতাবলম্বীদের, সমালোচকদের গড়পড়তাভাবে ‘নাস্তিক’, ‘রাম-বাম’, ‘সেক্যুলার(গালি হিসেবে)’, ‘ইসলাম বিদ্বেষী’, ‘ইসলামোফোবিক’, ‘ইসলামের শত্রু’ ইত্যাদি তকমা দেয়ার প্রবণতা এই আন্দোলনের সময়েও লক্ষ্য করা গেছে।
গ) এসব ঔপনিবেশিক-সেক্যুলারিস্ট-পরিচয়বাদী জোড়-বিপরীত চর্চা সমাজে বিভেদ, হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভাজন বাড়ায়, ন্যায়-ইনসাফের সংগ্রাম দূর্বল হয়। ফলে তা জুলুমশাহী(=অন্যায়-অবিচার-শোষণ-বঞ্চনা-জুলুমভিত্তিক রীতিনীতি-শাসন ও প্রতিষ্ঠান) বহাল ও জোরদার রাখতেই ভূমিকা রাখে, জুলুমশাহী বন্ধ করতে নয়।
২.এজেন্সি (=সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সে মোতাবেক সক্রিয়তার ক্ষমতা) ও সমরূপতা:
‘সেক্যুলার’/’প্রগতিশীল’/‘বাংগালী জাতীয়তাবাদীরা’-কিছু ব্যতিক্রমবাদে- সবাই মাদ্রাসার ছাত্রদের সমসত্বরূপে(হোমোজেনাইজড)কল্পনা করে। তাদের’নিস্পাপ’,’অবুঝ’, ‘হুজুরদের হাতের পুতুল’ ইত্যাদি হিসাবে ভাবে। ‘বাম/‘সেক্যুলার’/‘প্রগতিশীল’ এবং ‘ইসলামি পরিচয়সমূহ’ নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তাদের সমরূপ(মনোলিথিক)ভাবে দেখার প্রবণতা সকল পক্ষে কমবেশী জারী আছে। এই আন্দোলনের সময়েও এসব প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
‘মিডিয়া’ বিরাজমান জোড়-বিপরীতকে বজায় রাখার ভূমিকা পালন করেছে। এই জোড়-বিপরীতের বাইরে আন্দোলন, ভাষ্য-বিশ্লেষণ এবং দেখার উপায়কে ‘মিডিয়া’ প্রান্তিকীকরণ করেছে।
৪. চিত্র ও কল্পনার রাজনীতি:
ক) বাংলাদেশের পরিচয় রাজনীতিতে পোশাক-আশাক, উপকরণ, অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, সেসব ব্যবহারের কৌশল ইত্যাদি কত প্রবল- তা এই আন্দোলনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ছবি আমাদের আবার ভাবতে বাধ্য করে।
খ) এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যতম মনোযোগ পাওয়া ছবি হলো ঘোড়ায় চড়া ‘হেফাজত কর্মী’র ছবিটা। এই ছবিটাকে সব পক্ষই একটা বক্তব্য (=স্টেটমেন্ট) হিসাবে পাঠ করেছে। অনেকে এটাকে ‘হৃত গৌরব’, ‘ভবিষ্যৎ কল্পনা’, ‘ইসলামের বিজয়’ ও ‘ইসলামি শাসন’ ইত্যাদি হিসাবে পাঠ করেছে। আবার অনেক পক্ষ এই চিত্রকে (=ইমেজ) পাঠ করেছেন ‘মধ্যযুগে’/‘অন্ধকার যুগে’ ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার/ইচ্ছার/ প্রকল্পের চিহ্ন হিসেবে। ‘প্রগতি বনাম পশ্চাদপদতা’ জোড়-বিপরীত ভাবনার দাপট সমাজে লক্ষ্যণীয়। এসব পক্ষের এমন জোড়-বিপরীত চর্চা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ প্রকল্পকে সেবা করে।
৫. আন্দোলন ও সংক্ষোভ প্রকাশের পরিসর:
‘বাঙালী’, ‘বাংলাদেশী’, ‘তৌহিদী জনতা’ ইত্যাদির সমাজতত্ত্ব, ক্ষমতা অবস্থান, পরিচয় ও এজেন্সি রচনা, স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস ক্যু) বজায় রাখা বা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা বোঝা আমাদের জন্যে জরুরী। এই আন্দোলনে যারা যুক্ত-বিযুক্ত-জালিম-মজলুম-উপকারভোগী-স্বাক্ষী হলেন, যারা ‘নিহত’/’হত্যার শিকার’/‘শহীদ’ হলেন- তারা ঠিক কোন সামাজিক-রাজনৈতিক-আদর্শিক অবস্থান থেকে আসেন ও কেন আসেন- সেটা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ। যারা সংক্ষুব্ধ- তারা কোন কোন পক্ষ, কোন কোন মাধ্যম ও মঞ্চ সংক্ষোভ প্রকাশের পরিসর হিসেবে বেছে নিলেন এবং কেন নিলেন তা নিয়ে ভাবতে পারি।
৬. ‘পরিচয়’, ‘শ্রেণী’ ও ‘লিঙ্গ’:
ধর্ম, ভাষা ও ইত্যাদির ঔপনিবেশিক-আধুনিক জাতিবাদী-পরিচয়বাদী রাজনীতি শ্রেণী পরিচয় ও বৈষম্যকে ব্যবহার করে, হাপিস করে এবং আত্মসাৎ করে। অন্যদিকে সাধারণভাবে, ‘সেক্যুলার’/‘প্রগতিশীল/‘বাম’রা ‘হেফাজত’ পরিচয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল মিশ্র শ্রেণীসত্তাকে সক্রিয় বিবেচনায় নেয় না। তারা সাধারণভাবে বিবেচনায় রাখেন না- কিভাবে, কতভাবে, কখন, কোন দেশ-কালে ‘ধর্ম’-ভাষা- নানান পরিচয়সমূহ শ্রেণী ও অন্যান্য মজলুম অভিজ্ঞতার স্মারক ও বাহক হয়ে ওঠে। মোদী সফর বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন পক্ষের এসব চিন্তা,বয়ান ও অবস্থানগুলোকে সক্রিয় বিবেচনায় নিতে পারি। আন্দোলনের সব পক্ষের তত্ত্ব, ভাষা,বয়ান এবং সাংগঠনিকতার মধ্যে কি কি ধরণের পুরুষালিতার উপস্থিতি ও উদযাপন দেখা গেছে এবং এগুলো বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে কী মাত্রায় যুক্ত তা খতিয়ে দেখতে পারি।
৭. সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রকল্পের সীমা:
কয়েকটি ভাবনা বিন্দু-
•কোন পক্ষ কি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ফ্যাসিবাদ-কর্তৃত্ববাদকে কিভাবে চ্যালেঞ্জ করে- তত্ত্বীয়ভাবে হলেও? কারা কিভাবে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করার প্রস্তাব করে? কারা কিভাবে রাষ্ট্রের জুলুম করার ক্ষমতাকে বাতিল করতে চায়? পক্ষগুলির চিন্তাকাঠামো ও কর্মকান্ড কি ন্যায়-অবিচার-শোষন-বঞ্চনার শাসন ও প্রতিষ্ঠান যথা পুরুষতন্ত্র-পুঁজিবাদ-কর্তৃত্ববাদের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনা হাজির করে? চলমান জুলুমশাহীকে ক্রিটিক-চ্যালেঞ্জ করে? ভাবা যায় এসব নিয়ে।
•পক্ষগুলির আকাঙ্খা এবং সীমা কি ঔপনিবেশিক আধুনিক-‘সেক্যুলার’ অভিজ্ঞতার ও রাজনীতির পরিচয়বাদী ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, নাকি এরও বাইরে, ন্যায়-ইনসাফ, মুক্তি ও স্বাধীনতার নতুন ভাবনা ও কর্মসূচি প্রস্তাব করে তারা- ভাবার অবকাশ আছে।
• পক্ষগুলি বহুজাতির, বহুভাষার, বহু পরিচয়ের মানুষের, ভয়মুক্ত, ন্যায়-ইনসাফের সমাজ বাংলাদেশ ও ‘উপমহাদেশ’ সমাজ কিভাবে কল্পনা ও নির্মাণ প্রস্তাবনা করে কিনা, করলে কিভাবে করে; সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের কী ধরণের ভিত্তি ও ভেদবিধান প্রস্তাব করে , সে ভেদ বিধান আভিজাত্যবাদী/ শ্রেষ্ঠত্ববাদী/পুরুষতান্ত্রিকতা/পরিচয়বাদের বাইরে কি না- এসব ভাবা জরুরী।
৮. আন্দোলনের মনোসামাজিক মানচিত্র ও সীমানা, উপমহাদেশে পরিচয় রাজনীতি:
কয়েকটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা প্রস্তাব-
•‘ভারত’, ‘পাকিস্তান’, ‘বাংলাদেশ’ এবং ঔপনিবেশিক পরিচয়বাদী রাজনীতির জট প্রসঙ্গ।
•‘ভারতে’ পরিচয়বাদী রাজনীতির পক্ষগুলির সুবিধার জন্যে বাংলাদেশে কেমন রাজনীতি দরকার হয়; ‘বাংলাদেশে’ পরিচয় জোড়-বিপরীত রাজনীতির জন্য ‘ভারতে’ কেমন রাজনীতি দরকার হয়; পরিচয়বাদী রাজনীতির বাইরে যেতে এসব অঞ্চলে জনগণের তরফে কেমন উদ্যোগ ও তৎপরতা দরকার- সেসব প্রসঙ্গ।
•পরিচয়বোধ, পরিচয়ব্যবস্থা, সীমানাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপ্রকল্পের বিউপনিবেশায়নের প্রশ্ন কেন জরুরী- ভাবা দরকার।
•বহুজাতির, বহুভাষার, বহু পরিচয়ের ‘বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান’ সমাজ কী ভূমিকা নিতে পারে- ভাবা জরুরী।
##
লোকায়ত বিদ্যালয় বিউপনিবেশিক সাম্য ও ন্যায়ের দেশ-দুনিয়া হাজির করার চিন্তা চর্চার পরিসর।