যৌনতার ধ্যান-ধারণা-অনুশীলন-আরাম-অভ্যাস-প্রতিষ্ঠানের সাথে পুরুষালিতা/ ব্যাটাগিরি/ হিজরাত্ব/ মেয়েত্ব/ নারীত্ব ইত্যাদি এবং লিঙ্গ ও জেন্ডার ধ্যান- ধারণার সম্পর্ক আছে। সাথে আছে লিঙ্গ-যৌনতা-প্রজনন বিন্যাসের কায়েমী ব্যবস্থার সম্পর্ক। আবার আগের সবগুলার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্ষণ-দখল-দমন-শোষণ সংস্কৃতি, আছে বর্ণবাদ-পুঁজিবাদ-পরিচয়বাদ/ জাতিবাদ-রাষ্ট্র-রাষ্ট্রবাদ-পুরুষতন্ত্রের সম্পর্ক। আছে এসবের বদল-বহালের প্রশ্ন , আছে কায়েমী জুলুমি ব্যবস্থার সুবিধাভোগীদের আরাম-আয়েশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ার ঝুঁকি জনিত উদ্বেগ, তার ভঙ্গুরতা আছে, ফলে কায়েমী পক্ষের তরফে বহুমাত্রিক ভায়োলেন্স বহাল আছে। ভঙ্গুর পুরুষালিতা (fragile masculinity)-র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রকাশ হিসেবে এগুলারে হয়তো ভাবা যায়। তাই এই কায়েমী জুলুম এবং জুলুমশাহীতে যারা মজলুম, তাদের অভিজ্ঞতার নানা বয়ানকে শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করে পুরা ব্যাপারটাকে ইনসাফি-ইহসানি মন নিয়ে বোঝাপড়ার প্রস্তাব থাকলো।
পুরুষালিতা আর ব্যাটাগিরির আলোচনা দিয়া ব্যাপারটাকে এঙ্গেজ করে দেখা যাইতে পারে- কদ্দুর কি বোঝা যায় এই ইস্যুতে। মানে, পুরুষালিতা ( masculinity)-র পর্যালোচনা দিয়াঃ কেমনে ব্যাটা/ পুরুষ- এর ধারণা তৈরি/ বিকাশ/ বিবর্তন হইতেছে নানান সমাজে; আর বিভিন্ন কালের সাম্রাজ্য, উপনিবেশ, বর্ণবাদ- পুঁজিবাদ, পশ্চিমা আধুনিকতা ইত্যাদি কিভাবে সেগুলাকে প্রভাবিত করতেছে। সেসব প্রভাব আবার কিভাবে ধর্ম/ দ্বীন/ কালাম বোঝাপড়ার সাথে সম্পর্কিত, কোনটা কিভাবে কোনটার ওপর কালে-প্রেক্ষিতে প্রভাব ফেলে। কিভাবে, কোনসব ধ্যান-ধারণা-অনুশীলন-প্রতিষ্ঠানের কারণে পর্দা, পাবলিক-প্রাইভেট এবং কর্তৃত্ব-দায়িত্ব ইত্যাদি বিভাজনের বিষম লিঙ্গব্যবস্থা ভিত্তিক-পুরুষতন্ত্র ভিত্তিক জালিমি যৌনতা-প্রজনন-পরিবার, যত্ন, প্রেম ও বন্ধুত্ব ব্যবস্থা বহাল রাখে। সেসবের আলাপ হয়তো শুরুতে যে জুলুম এর কথা বললাম আমরা, তার ব্যবস্থা, প্রকরণ, নির্মাণ বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমাজেও জেন্ডার এবং যৌনতার আলাপে পুরুষালিতা বড় বিষয়, যার সাথে যুক্ত আছে ‘মুসলিম পুরুষ’ পরিচয় নির্মানের জটিল সম্পর্ক। ‘ইসলামি উম্মাহ’র কোনো সুনির্দিষ্ট ‘পুরুষালিতা’র কাঠামো আছে? নাকি আছে ‘আদর্শের’ একাধিক/ বহুরকম ভাবনা, ভাষ্য, বুঝ, নির্মাণ ও অনুশীলন? বরং বাংলাদেশেও অনেকেই ঘাড়ের রগ ফুলানো ব্যাটাগিরিসহ বিষাক্ত পুরুষালিতা (Toxic Masculinity)-র বহুচর্চাকে মুসলমানিত্বের একটা বড় লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করেন। ‘আদর্শ’ রকমের পুরুষালিতার বুঝ- বিবেচনা কিভাবে তা সাব্যস্ত হয়, নির্মিত- পরিবর্তিত হয়? বিষাক্ত পুরুষালিতার (Toxic Masculinity) সাথে ইমান আর মুসলমানিত্বের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে? আধুনিকতার বিশাল প্রভাবের সীমার মধ্যকার পুঁজি- পরিচয়- সীমান্তবাদী- পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্প ও রাষ্ট্রবাসনা কি ধরণের পুরুষালিতা দাবী করে বা নির্মাণে ভূমিকা রাখে? তা কি কোনোভাবেই ইনসাফি পুরুষালিতা? বাংলাদেশে, বাঙ্গালী মুসলমানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই সমাজে এই দাবী এবং এই ভূমিকা কিভাবে কাজ করে? এই সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ম্যাস্কুলিনিটির ভঙ্গুরতা(fragility) এবং এই ভঙ্গুরতা বা ফ্রাজাইলিটিজনিত জুলুম কিভাবে বহাল থাকে? তাকে কিভাবে চেনা যায়? প্রচলিত বাইনারি/ জোড়- বিপরীত লিঙ্গ ভাবনার/ ভাবনা পদ্ধতির ব্যবস্থার সমস্যার দিক আছে কিনা, এর বাইরে গিয়াও দিন- দুনিয়া বোঝা যায় কিনা, সেটা জরুরী কিনা, বেশি ইনসাফপুর্ণ কিনা, হইলে সেটা কেন, কিভাবে, এসব ভাবা দরকার। আমাদের সমাজে লিঙ্গ আর যৌনতার ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির ইনসাফি বোঝাপড়া- অনুশীলনের জন্যে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া আবশ্যক।
যাহোক, পুরুষতন্ত্র, ম্যাস্কুলিনিটি/ ফেমিনিটি/ নন-কনফর্মিটি ইত্যাদি, জেন্ডার এবং সেক্স্যুয়ালিটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক পর্যালোনার নানা ধ্যান-ধারণা ও এপ্রোচের সাথে আমাদের অন্তত প্রাথমিক পরিচয় আছে ধরে নিয়ে আপাতত যদি ‘আরব’ আর মুসলিম প্রধান সমাজগুলার ইতিহাসের মধ্যে আলাপ রাখি, তাইলে কিছু নাম এখানে উল্লেখ করা যায়।
কিভাবে ইসলামের আবির্ভাবের আগে-কালে-মধ্যে-পরে জেন্ডার, যৌনতা আর পুরুষালিতার ধ্যান- ধারণা বদলাইতেছে তার অনুসন্ধানের নমুনা হিসেবে দেখতে পারিঃ Women and Gender in Islam: Historical Roots of a Modern Debate. Reissue Edition. by Leila Ahmed;
‘আরব’ অঞ্চলের মানুষজন/ সমাজে ‘বাসনা’ তথা জেন্ডার- যৌনতা- কামনা- বাসনার ধারণা চর্চা কেমনে নিজেরা সামলাইছে বা পরে মিল- মোকাবেলা করতেছে পশ্চিমা উপনিবেশ আর আধুনিকতার সাথে- তার একটা বোঝাপড়ার নমুনা হিসেবে দেখতে পারিঃ Desiring Arabs . Joseph A. Massad ;
ইসলামের ইতিহাসে, মুসলিম প্রধান সমাজগুলাতে, ইসলামের নানান ট্র্যাডিশনে ম্যাস্কুলিনিটির ধারনা- বিবর্তন- বোঝাপড়া কেমনে চলতেছে তার উদাহরণস্বরুপ দেখতে পারিঃ Islamic Masculinities. Edited by Lahoucine Ouzgane ;
মুসলিম সমাজে ম্যাস্কুলিনিটিগুলার ‘সংকট’- এর স্বরূপ কেমনে বুঝা যায়, তার একটা নমুনা হিসেবে The Crisis of Islamic Masculinities, by Amanullah De Sondy দেখতে পারি।
মজলুমের নীতি দিয়া কোরান পাঠের অনেক নজির আছে দুনিয়ায়, তার কিছু পর্যালোচনা আছে এই বইয়েঃ Qur’an of the Oppressed: Liberation Theology and Gender Justice in Islam. Shadaab Rahemtulla, মাওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ ইত্যাদি। লিঙ্গ- যৌনতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বান্দারা পরম করুনাময়ের সঙ্গে কিভাবে- কতভাবে সম্পর্ক বানায়- সেসবের আলাপ ছাড়া তো এই আলাপ কল্পনাই করা যায় না। সেখানেও কত ধারা- উপধারা আছে। তার কিছু নজিরঃ A Women’s March Without God (The Father) By Fatima Seedat; Allah, Hidden Treasures, And The Divine Feminine. Sa’diyya Shaikh; আর ইনসানিয়াতের আলাপ তো খুবই প্রাসঙ্গিক, তাই দেখা যাইতে পারেঃ In Search of al-Insan: Sufism, Islamic Law, and Gender. Sa’diyya Shaikh।
এর সাথে আমাদের মাথায় রাখতে হবে ম্যাস্কুলিনিটি- ফেমিনিটি, জেন্ডার/ সেক্স/ লিঙ্গ- যৌনতা ভাবনার বিউপনিবেশায়নের জরুরী রাজনীতি বোঝাপড়ার প্রসঙ্গ। জেন্ডার এবং ম্যাস্কুলিনিটি অধ্যয়ন শাস্ত্রের বিউপনিবেশায়নের কাজটাও। লিঙ্গ এবং জেন্ডার ধারণা, এসবের ধারণাগত- সামাজিক- ঐতিহাসিক নির্মাণ- বিবর্তনের ইতিহাসের সাথে সম্যক পরিচয় থাকা লাগবে। সাথে, চন্দ্রা মাহান্তি (Chandra Talpade Mohanty)’র ‘Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourses’, ‘Feminism Without Borders: Decolonizing Theory, Practicing Solidarity’- এসব রচনা; লুগোনেস (Maria Lugones) এর The Coloniality of Gender ; Toward a Decolonial Feminism; লালন ফকিরের প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কালাম, রোকেয়া রচনাবলী ইত্যাদি পরামর্শ করলে এসব ব্যাপারে কিছু দরকারি ভাবনাসূত্র পাওয়া যাবে আশা করি। উপনিবেশ ও বিউপনিবেশায়ন প্রসঙ্গে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক পাঠ পরামর্শ পাওয়া যাবে ‘লোকায়ত’ সাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন রিডিং লিষ্ট-এ। আগ্রহীরা সেসব দেখতে পারেন।
> Speaking in God’s Name: Islamic Law, Authority and Women. Khaled Abou El Fadl .
> Gender and Sexuality in Islam। Edited By Omnia El Shakry;
> Islam and Gender: Major Issues and Debates. By Adis Duderija, Alina Isac Alak, Kristin Hissong;
> Men in Charge?: Rethinking Authority in Muslim Legal Tradition by Ziba Mir-Hosseini (Editor), Mulki Al-Sharmani (Editor), Jana Rumminger (Editor).
> The Routledge Handbook of Islam and Gender. Justine Howe.
> Women as Prophets in Islam. Maribel Fierro (In, ‘ Writing The Feminine: Women in Arab Sources. Edited by Manuela Marín and Randi Deguilhem)
> “Idhan Maryam Nabiyya” (“Hence Maryam is a Prophetess”): Muslim Classical Exegetes and Women’s Receptiveness to God’s Verbal Inspiration। Hosn Abboud (In, Mariam, the Magdalen, and the mother. Edited by Deirdre Good.)
> The Masculinity Studies Reader. Rachel Adams (Editor), David Savran (Editor);
> Routledge International Handbook of Masculinity Studies. by Lucas Gottzén (Editor), Ulf Mellström (Editor), Tamara Shefer (Editor) .
> The Bloomsbury Reader in Religion, Sexuality, and Gender. Editor(s): Donald L. Boisvert, Carly Daniel-Hughes.
> Religion and Sexuality. Editor(s): Michael A. Hayes, Wendy Porter, David Tombs
https://www.lokayoto.org/2020/11/27/shariah-a-reading-list/
https://www.lokayoto.org/2020/02/10/din-duniya-islam/
> ‘প্রাচীনযুগের শেষভাগ’, ‘আল-জাহিলিয়া’ এবং ইসলামের আবির্ভাবকালের ইতিহাসঃ কয়েকটা বই ও প্রবন্ধের হদিসঃ
https://www.lokayoto.org/2020/09/10/late-antiquty_jahiliya_islam_reading/
> সেক্যুলারিজম বিতর্কঃ একটা পাঠসুত্র ।। https://www.lokayoto.org/2019/09/08/secularism_readinglist/
দ্বীন, ধর্ম ও উপাসনা অধ্যয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠের জন্যে একটা পাঠতালিকা পাইতে নজর রাখেন https://www.lokayoto.org/category/reading-list/ পেজে।
আরো অনেক আলাপ, দলিল, রেফারেন্স আছে। আমরা যদি নিজেদের ইনসাফি রূপান্তর অনুশীলনে আগ্রহী হই, তাহলে নিজেরাই অনেক রেফারেন্স, দলিল, ব্যাখ্যা, ভাষ্য খুজে পাবো, নিজেদের আরো একটু ইনসাফি মত ও অবস্থান খুঁজে নিতে পারবো।
মনে রাখতে হবে- এই তালিকা নির্মাণটা নানাদিক থেকে সীমাবদ্ধ কিন্তু চলমান। এতে যোজন-বিয়োজন ও পরিমার্জন চলতে থাকবে। যেসব জিনিসপত্রের নাম দেয়া আছে- তার সব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজানো আছে- এমন না। সহজ- কঠিনের ক্রমানুসারেও সাজানো নয় এই তালিকা। এসবই পাঠকের বিবেচনা ও অগ্রাধিকারের আওতায়।
তালিকাটা প্রাথমিক একটা সূত্র হিসেবে হাতে রেখে পড়াশুনা করতে গিয়ে পাঠক নিজেই তার নিজের অগ্রাধিকার পাঠের তালিকার দিকে যেতে পারবেন বা যাবেন বলে আশা করি।
পরামর্শ থাকবে- একটা বা দুইটা কোনো জিনিস পড়ে- শুনে সিদ্ধান্ত বা মত চুড়ান্ত না করার। ভিন্নমতগুলির সাথে চেনা- জানার চেষ্টা খুব কাজের। এটা বিবেচনায় রেখে চেষ্টা আছে এই তালিকা যথাসম্ভব ভারসাম্য ও পর্যালোচনামূলক রাখার। কোনো মত বা সিদ্ধান্ত প্রস্তাব করা বা চাপিয়ে দেয়া এই তালিকার উদ্দেশ্য নয়। বরং, একটা সামগ্রিক পর্যালোচনার তদবির যেন সমাজে চলে- সেটা এই তালিকা করার প্রধান উদ্দেশ্য।
তালিকায় উল্লেখ করা এই পর্যায়ে সম্ভব হচ্ছেনা, কিন্তু, একেক রচনার/ টেক্সটের একেক রচনা সময়, অঞ্চল বা প্রেক্ষিত। তার আগে পরে, বিভিন্ন অঞ্চলে সে বিষয়ে আরো অনেকের অনেক কাজ থাকতে পারে বা আছে- সেসবের সাথে পরামর্শ করা জরুরী, তা না হলে কোনো রচনার ওপর অবিচার করা হয়ে যাইতে পারে। বাংলা ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় জিনিসপত্র এত কম কেন- এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবাই মিলে খুঁজতে হবে, সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে ।
পরম করুণাময় আমাদের হেদায়েত করুন। আমিন।
অরূপ রাহী
কার্তিক, ১৪২৭। নভেম্বর ২০২০।
কপি সম্পাদনাঃ মোহাইমিন লায়েছ। প্রুফ সম্পাদনাঃ হাসিবুল হাসান শান্ত