সাক্ষাৎকার গ্রহণঃ ইয়ান ট্রুগার , হ্যালি নেইল । অনুবাদঃ স্বাক্ষর শতাব্দ।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, নৃবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ। তিনি সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নৃতত্ত্ব এবং মধ্যপ্রাচ্য’, ‘দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকান স্টাডিজ’ এর অধ্যাপক, সেই সাথে কোলকাতার ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্স’ এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্মানসূচক অধ্যাপক। তাঁর লেখাপত্রের মধ্যে আছে ‘ন্যাশনাল থট এন্ড দ্য কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড এবং দ্য নেশন এন্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টস ’ এর মতন প্রভাবশালী কাজ। কলম্বিয়া জার্নাল অফ লিটারারী ক্রিটিসিজম বসেছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, আলাপের বিষয়- ভারতে বিজেপির গরুর মাংস নিষিদ্ধকরণ, পোশাকের রাজনীতি এবং সেক্যুলারিজম ও আধুনিকতার উত্থান।
কলম্বিয়াঃ মহারাষ্ট্রে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করতে ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি)র সাম্প্রতিক তৎপরতার ব্যাপারে আপনার মত কী?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি জানিনা এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনারা খোঁজ রাখছেন কীনা, তবে এই বিষয়টা বোম্বেতে কোর্ট পর্যন্ত গেছে। পেছনের ঘটনা হলো, উত্তর ভারতের বহু রাজ্যেই অনেক বছর ধরে গো–হত্যা নিষিদ্ধ, যার বেশিরভাগই ১৯৬০ সাল থেকে কার্যকর। তবে অন্য রাজ্য বা বিদেশ থেকে গোমাংস আমদানি অনুমোদিত ছিল। ফলে কার্যত গরুর মাংস বেচাবিক্রি অব্যাহত ছিল, কিছু নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁতে গরুর মাংস পাওয়া যেত, এবং নিশ্চিতভাবেই কিছু মানুষ তার ভোক্তা ছিল। এখন সাম্প্রতিক সময় যেটা ঘটেছে তা হলো, মহারাষ্ট্র সরকার গরুর মাংস সংগ্রহ, বেচা ও খাওয়া তিনটাকেই বে–আইনী করে দিয়েছে।
যারাই কোর্টে গিয়েছেন, তাদের অভিযোগ হলো- এটি ব্যাক্তি স্বাধীনতার উপর আক্রমণ, বা মৌলিক অধিকার হরণ। এর ফলে, মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারও যুক্তি দেখাচ্ছে যে, এই নিষিদ্ধকরণের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই, কারণ সেটা হোলে সাথে সাথেই তা একটি ধর্ম বা সেই ধর্মের ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে অন্য ধর্মগুলির উপরে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে- এমন একটা বৈষম্যের প্রশ্ন চলে আসে। কোর্ট যে এই বিশেষ আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে ষোষনা করবে সেই সম্ভাবনাই বেশি ছিল। ফলে মহারাষ্ট্র সরকারের পক্ষে যা করার দরকার ছিল, তা হলো এইটুকু বলা যে, “এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই বরং এটি প্রাণী অধিকারের সাথে সম্পর্কিত”। কৃষিতে উপযোগিতা থাকার কারণে নির্দিষ্টভাবে গবাদি পশু ও গরুকে মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করার মনোভাব সারা দেশেই ব্যাপকভাবে বিরাজমান আছে, যে জন্যে গরুকে একটি নির্দিষ্ট বোধ থেকে পূজা করা হয়। সুতরাং এর সাথে ধর্মের কোনো যোগ নেই, বরং একটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণের সাথে এটা জড়িত।
কলাম্বিয়াঃ এটা তো হলো তাদের বক্তব্য।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ ভারতীয় গ্রামীণ অর্থনীতির প্রকৃত সমস্যা হলো, উদ্বৃত্ত গবাদি পশু, যাদের কোন উপযোগিতা নেই। ফলত, এটা একটা অদ্ভুত যুক্তি। সারমর্মের দিক থেকে, এই যুক্তি–বিচারের সাথে ধর্ম–পরিচয় ভিত্তিক একটি নির্দিষ্ট ধারার কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবেই যুক্ত, যেখানে এর প্রকৃত টার্গেট হলো—মুসলমানেরা, এবং এখন ক্রমবর্ধমান হারে খৃষ্টানরাও।
কলাম্বিয়াঃ তাহলে কি বিজেপির ব্যাপারটা আসলে সাম্প্রদায়িক দিক থেকে চালিত?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ তারা আরো সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যে যুক্তিটা দেখাবে তা হলো, “মুসলমানেরা সার্বিকভাবে অনেকগুলি সম্পূর্ণ ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দাবি-দাওয়া চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে অনেকগুলি নিতান্তই অযৌক্তিক, কিন্তু কেউ কিছু বলতে চায় না কারণ তারা সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত,এজন্য আপনাকে তাদের সংবেদনশীলতাকে সম্মান করতে হবে, কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে কী হবে?” এই ধরণের যুক্তিই তারা বানাতে থাকে। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার, ভারতে গরুর মাংসের ভোক্তা কারা? সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে গরুর মাংসের ভোক্তা নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের দরিদ্রতম অংশটি। কিন্তু দেশের দক্ষিণে, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও ব্যাপক আকারে গোমাংস খাওয়ার চল রয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে, নির্দিষ্ট করে বললে গোয়া এবং কেরালায় প্রায় প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যাপকভাবে গরুর মাংস খাওয়া হয়। কেরালায় খৃষ্টানেরা, এমন কি হিন্দুরা—উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও— প্রায়ই গরুর মাংস খেয়ে থাকেন।
কলাম্বিয়াঃ এই যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও এলাকা ভিত্তিতে গোমাংস খাওয়ার একটা বিষমানুপাত আছে, এটি কি বিজেপি আমলে নিয়েছে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ না। যদি এই যুক্তি দেখানো হয়, তখন তারা বলবে এটা এক ধরণের স্থানীয় ব্যতিক্রম।
কলাম্বিয়াঃ লক্ষ্য করার বিষয় হলো তারা বেশ কায়দা করে এই যুক্তিটা দেয়ার চেষ্টা করে। সুদীপ্ত কবিরাজের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যখনই এ ধরণের মতভেদ হয়, কংগ্রেস পার্টি তাকে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে তাড়িত হয়, এবং বিজেপির তাড়না থাকে ব্যাপারটিকে জাতীয়করণের দিকে। আপনার কী মনে হয়, এক্ষেত্রে সেক্যুলারিজমের ধুঁয়া কি ইতিবাচক নাকি ক্ষতিকারক ভূমিকা রাখে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ সেক্যুলারিজমকে নানা উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এক ধরণের সেক্যুলারিজম দেখি আমরা তুরস্কের মতন দেশে, যেখানে সেক্যুলারিজমের সাথে জড়িত কামাল পাশার আমলে সমাজের ব্যাপক পশ্চিমাকরণ ঘটে, ফলে সেখানে সেক্যুলারিজমের মানে কার্যত দাঁড়িয়েছিল ইসলামের দমন। ভারতে এই ধরণের শক্তিশালী সেক্যুলারিজম কোনো কালেই ছিল না। রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে ধর্মকে জনপরিসরের (public domain) বাইরে রাখার এই ধরণের চেষ্টা ভারতে কখনোই চর্চা হয়নি। উদ্বেগটা বরং এই নিয়ে বেশি ছিল যে, “একাধিক ধর্মের দাবিগুলিকে একই সাথে কীভাবে সামলানো যায়? রাষ্ট্র কীভাবে এটা সামাল দিতে পারে?” রাষ্ট্রের জন্য সেক্যুলারিজমের প্রধান চিন্তার বিষয় হলো, কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নেই, এটি কীভাবে দেখানো যায়। এখানে প্রশ্নটা খুব সহজভাবে বললে, “কোনটিকে আসলে পক্ষপাতিত্ব বলে বিবেচনা করা হবে?”।
কলাম্বিয়াঃ ১৯৮০‘র বছরগুলিতে বিজেপির অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের নীতি এক ধরণের “ছদ্ম সেক্যুলারিজম“। সব ধর্মের জন্যই ব্যবস্থা রাখাকে আসলে সেক্যুলার হিসেবে দেখা হয় নি, কারণ রাষ্ট্র সকল প্রকার ধর্মীয় বিষয় থেকে মুক্ত, এমন নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে নি। বিজেপির যে রাজনৈতিক নীতি, তার মধ্যে ইদানীং কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন, বিশেষ করে পোশাক-আশাক এবং গোমাংসের ভোগ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ দেখুন, বিজেপির কিছু অংশের জন্য এটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক চাল, কারণ ছদ্ম–সেক্যুলারিজমের প্রাথমিক যুক্তি ছিল, আইনের প্রয়োগ সবখানে সমান হতে হবে। সেক্যুলারিজমের ঐ দাবি তোলা হয়েছিল, আলাদা আলাদা ব্যক্তি আইন (personal laws-বিবাহ, উত্তরাধিকার, ইত্যাদি) ক্ষেত্রে সর্বজনীন আইনের বিধিবিধান প্রণয়নের চাহিদা থেকে। কংগ্রেস এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে, সংখ্যালঘুর জন্য বিশেষ আইন সমর্থন করে। এবং এটাকেই বলা হচ্ছিল ছদ্ম–সেক্যুলারিজম। আজকের দিনে লক্ষ্যণীয় হলো, এই বিতর্কটা মনে হচ্ছে যেনো দুর্বল হয়ে গেছে। বিজেপিকে এখন আর খৃস্টান বা মুসলিমদের আইন রদ করার দাবি তুলতে শোনা যায় না। গো–মাংসের তর্কে লক্ষ্যণীয় হলো, এটা প্রায় নতুন এক ধরণের সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ। এটা যে প্রশ্নটিকে সামনে তুলে ধরে তা হলোঃ ভোটারদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশের মতামতকে কেন অগ্রাধিকার দেয়া হবে না?
কলাম্বিয়াঃ সেক্যুলারিজম ঘিরে বিস্তৃত আলাপ-আলোচনার মধ্যে ভারতকে ফেটিশাইজড (fetishized) এবং সেক্যুলারিজমের এক বিশেষ কেস স্টাডি হিসেবে দেখা হয়। আমার প্রশ্ন হলো, আপনি কি মনে করেন- এটা সঠিক? যদি তাই হয়, তাহলে কি ফরাসী লাইসিতে (laïcité) এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে একই পাটাতনে রেখে আলাপ করা সম্ভব?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ লাইসিতে (laïcité) দেশ-কাল-পাত্র বিশিষ্টতাযুক্ত একটা ধারণা ও চর্চা, ফ্রান্সে যার লম্বা ইতিহাস। যখন লাইসিতে গৃহীত হয়, তখন ফ্রান্সে কারা সেই ভিন্ন রিলিজিয়াস সংখ্যালঘু ছিলেন যাদের উপরে এর প্রভাব সবচাইতে বেশি পরেছিল? লাইসিতে মূলত ছিল প্রোটেস্টান্ট আর ক্যাথলিকদের মধ্যে একটা চুক্তির মতো, যেখানে বলা হলো, “চলো আমাদের মধ্যকার ধর্মীয় বিভেদ ভুলে যাই— সমাজের যত পরিসরে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা- তত পরিসর পর্যন্ত ‘রিলিজিয়ন’-এর বিষয়-আসয় আনবোনা”। কট্টর অর্থে এটাই লাইসিতে (laïcité)। রিপাবলিকের প্রথমদিকের কথাও যদি চিন্তা করেন, তা হলে দ্রেফিউ(Dreyfus) কাণ্ডর মত কিছু ব্যাপার বেড়িয়ে আসে। এখানে ইহুদীদের অবস্থান কি? পুরো ব্যাপারটা নিয়েই পুনরায় দরকষাকষি-সমঝোতার দরকার পরেছিল। ইহুদীর কি এখানে আদৌ কোন জায়গা আছে? “আমরা যদি ব্যক্তিগত পরিসরে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারি, আমরা কি সিনাগগ স্থাপন করতে পারবো?” ফ্রান্সে এমনকি আজকের দিনেও একজন ইহুদী কিপ্পাহ( skullcap) পরিধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারে না। বিধিসম্মত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যেটা ঘটলোঃ মাগরেব থেকে আসা অভিবাসনের নতুন ঢেউ এবং সেই অভিবাসীদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। যে চুক্তির উপর লাইসিতে প্রতিষ্ঠিত, সেই চুক্তির শুরুর দিকের অংশে এই মানুষগুলি কখনোই ছিলোনা। ফলে এটা আরেক দফা নতুন দর কষাকষি, যা এখন চলছে। “ব্যক্তিগত পরিসরে রিলিজিয়ন” এর মানে আসলে কী?
কলাম্বিয়াঃ এমনকি জন ও ব্যক্তিগত পরিসরের(public and private spheres ) ধারণাসুচক বর্গগুলি ইতিহাস সঞ্জাত, ফলত, এসব ধারণাসুচক ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সেক্যুলারিজমের যে নানা ধরণ-ধারণ, সেগুলিও ইতিহাস সঞ্জাত। দেশ-কাল-পাত্রের মাত্রাযুক্ত এসব ধারণা যখন ভারতে প্রয়োগ করা হয়, তখন সেসব কীভাবে কাজ করে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ এখানে এর মধ্যস্ততা বেশ ভিন্নভাবে ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ক্ষেত্রে আপনি যদি হিজাব পরেন, পরতে পারেন। আপনি এটা করতে চাইলে করতে পারবেন। পোশাক–পরিচ্ছদ, মস্তকাবরণ(headgear) ইত্যাদির বেশ একটা লম্বা ইতিহাস এখানে আছে, যার সাথে নির্দিষ্ট গোত্রীয়, ধর্মীয়, নানা প্রকারের সম্পর্ক জড়িত। এবং লোকজন এগুলি স্বাধীনভাবেই দেখিয়ে বেড়াতে পারে যেরকম তারা চায়, যদিও এসব সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছেঃ আপনি যদি বিশ শতকের গোড়ার দিকে তোলা বা আঁকা কোনো ছবির দিকে তাকান, তাহলে রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষের মধ্যে বহুরকম মস্তকাবরণের দেখা পাবেন। প্রত্যেকটা মস্তকাবরণ একটা নির্দিষ্ট ধরণকে প্রতিনিধিত্ব করে– কোনো একটা জাত, কোনো একটা নির্দিষ্ট এলাকা, একটা ধর্মীয় পরিচয়, এই রকম সকল ধরণের। এখন আর এগুলি নেই, ভারতে কেউই আর মস্তকাবরণ পরিধান করে না। কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত পরিচয়ের কতটুকু আপনি জনপরিসরে ( public space) প্রদর্শন করবেন- ঐতিহাসিকভাবে সময়ের সাথে সাথে এই প্রশ্ন ফয়সালার দরাদরি চলেছে । উদাহরণস্বরূপ, নারীদের মাথার আবরণ হিসেবে ওড়না বা হিজাব পরার ক্ষেত্রে যে ধরণের পরিস্থিতি পাওয়া যায় ফ্রান্সে, এরকমটা ভারতে কখনোই ঘটবে না, কারণ আপনি কী পরবেন কী পরবেন না সেটাকে এখনো ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই মেনে নেয়া হয়। একজনের ব্যক্তিগত পরিচয় পাবলিক পরিসরে (public place) নিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই। মহিলাদের মাথায় কাপড় দেয়া নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির মতন কিছু ভারতে কখনোই ঘটবে না। আমি বরং বলবো, ফ্রান্স এ ব্যাপারে সেক্যুলারিজমের ভারতীয় ধরণ থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারে।
কলাম্বিয়াঃ তো আপনি কি মনে করেন, ফ্রান্স সেক্যুলারিজমের ভারতীয় ধরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি সেটা বলতে চাই! কিন্তু ফ্রান্সে সেক্যুলার পরিচয় হিসেবে যেটা গড়ে উঠেছে তা চার্চের ঐতিহ্যের সাপেক্ষে। সেখানে একটা গুরুতর লড়াই হয়েছে এবং তা একটা নির্দিষ্ট উপায়ে জয়ী হয়েছে। বোধগম্য যে, যারা মনে করে এটা জয়, তারা সেই জয়কে হাতছাড়া করতে চাইবেনা।
কলাম্বিয়াঃ কিন্তু সময় তো চলমান …
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ হ্যাঁ অবশ্যই। বহুরকম মানুষ আছেন, যারা চার্চ আর রিপাবলিকের মধ্যেকার এই লড়াইটা এমনকি বোঝেন না পর্যন্ত, এবং এর তাৎপর্যওবোঝেন না। এগুলির কী মানে- তা এই যে নতুন মানুষেরা যারা ইউরোপে ঢুকছেন– তাদের বেশিরভাগেরই কোনো ধারনাই নাই। কেনই বা থাকবে?
কলাম্বিয়াঃ একটা যুক্তি আছে যে, ইউরোপের সেক্যুলারিজম সারমর্মের দিক থেকে কেবলই খৃষ্টধর্ম। হিন্দু কোড বিল একজন ভারতীয়কে হিন্দুই ধরে নেয় যতক্ষণ না কেউ অন্যথা প্রমাণ করতে পারে। আপনি কি ভারতের ক্ষেত্রে একটা সমতুল যুক্তি দাড় করাতে পারেন যেখানে ‘সেক্যুলার’ আসলে নির্দেশিত হয় ‘হিন্দু’ হিসেবে?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ এখানে একটা ভিন্নতর সমস্যা আছে। হিন্দু কোড বিলের জন্যও লড়াই করতে হয়েছিল, কেননা ‘হিন্দু’ সমাজ বলতে যে ব্যাপক আকারের বৈচিত্র্যময়তাকে বিবেচনা করা হয়, তা সম্পূর্ণভাবে মুছে দিয়ে একটা একক আইনী কাঠামো সব ‘হিন্দু’র জন্য চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিল। এটিকে সবার জন্য একটা অভিন্ন দেওয়ানী বিধির (uniform civil code) প্রয়াস বলেই মনে হচ্ছিল। এটা যে শুধু হিন্দুদের উপর প্রযোজ্য ছিল তার কারণ, মুসলিম পরিচয়ের প্রশ্নকে খুবই সংবেদনশীল বলে মনে করা হত। এও সম্ভব যে, দেশভাগ ওরকম নির্মম পরিণতি না নিয়ে আসলে, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি (uniform civil code) প্রতিষ্ঠার প্রয়াসটা অনেক বেশি শক্তিশালী হতো। এটি এখনো সংবিধানে সেই আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাগুলির একটা হয়ে আছে। ফলে, একভাবে চিন্তা করলে, ফরাসি ধরণের সেক্যুলারিজমের ধারণাই একটা যথাযথ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাঙ্খিত লক্ষ্য বলে ধরা হয়েছিল- যাতে ধরে নেয়া হয় সকল আইন সব রকম নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য।
কলাম্বিয়াঃ কিন্তু এটা তো অবাস্তবায়নযোগ্য ছিল।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ এটা বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না, এবং এটাকে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি হিসেবে দেখা হয়েছে। অথবা একটা সাময়িক পরিস্থিতি হিসেবে, যেনঃ “আমরা ঐ অবস্থায় পৌছাবো ঠিকই, কিন্তু এই মুহুর্তে, এটা অর্জন করার জন্য সচেষ্ট হওয়া ঠিক হবে না।” আজকের দিনে অবশ্যই এমনকি বিজেপিও মনে হয়না এই এজেন্ডা এগিয়ে নিতে আদৌ আগ্রহী। এখানে সংযুক্ত প্রশ্নটি হচ্ছে, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি (uniform civil code) যা কিনা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে– সেটির জন্য হিন্দু কোড বিল আদৌ কোন উপযুক্ত মডেল কিনা– কেন সেটা হবে? কেউ এই যুক্তি দেখাতেই পারেন– শুধু হিন্দুদের উপর প্রযোজ্য কোনো কিছুর উপর ভিত্তি করে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি (uniform civil code) গড়ে উঠতে পারে না। সব সময়ের মতই, এটা এমন ব্যাপার যেটাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা দরকার যা কখনোই হয়নি। আরেকটা বিষয় হলো, যখন কেউ বলে, ‘পশ্চিমা সেক্যুলারিজম’, তাকে বুঝতে হবে যে তারও অনেক রকমফের আছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলারিজম ব্রিটেন বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সেক্যুলারিজম থেকে ভিন্নতর। এই জায়গাগুলির অনেকখানেই আসলে প্রতিষ্ঠিত চার্চ আছে। তারা এটাকে সেক্যুলারিজমের পথে বাঁধা হিসেবে দেখে না।
কলাম্বিয়াঃ আপনি কি মনে করেন যে, সেক্যুলারিজম সম্বন্ধে তালাল আসাদের বর্ণনার একটা সম্ভাব্য সমালোচনা হতে পারে যে, উনি খৃষ্টধর্মকে খুবই একশিলা (monolithic) হিসেবে চিন্তা করেন, এবং সেক্যুলার উপাদানগুলি (the secular compact) নিয়ে দেশ ভেদে যে বিভিন্ন উপায়ে সমঝোতা (negotiated) হয়েছে, তা উনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ এটা ঠিক। কিন্তু তালাল আসাদও এই ব্যাপারটিকে অস্বীকার করবেন না। তালাল আসাদের মূল বক্তব্য হলো যে, যখন থেকে সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি, তখন থেকেই রিলিজিয়নেরও শুরু। সেক্যুলারিজমের পূর্বে রিলিজিয়ন বলে কোন ব্যাপার নেই। ফলে রিলিজিয়নকে যখন এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, “এটা হলো ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আচার-অনুশীলন”, তখন একটা সমস্যা হাজির হয়, ইউরোপের অনেকগুলি প্রোটেস্টান্ট দেশে ‘জাতীয় চার্চ’ বা আইন করে জাতীয়করণকৃত চার্চ আছে। ফলে, রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট রিলিজিয়নের সাথে সম্পৃক্ততার পরিচয় দিচ্ছে, যদিও আপনি বলতে পারেন যে, বাস্তব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অন্যান্য রিলিজিয়নের সাথে বৈষম্য করে না। কিন্তু এটা (জাতীয় চার্চ) একটা বাস্তবতা।
কলাম্বিয়াঃ আশিস নন্দীর মতে সেক্যুলারিজম মৃত। আপনার বিশ্লেষণ কি?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি এটাকে মৃত বলে মনে করি না। আবার দেখেন, এটা নির্ভর করে সেক্যুলারিজম বলতে আপনি কি বোঝেন, তার উপরে। যদি বলেন যে, ফ্রেঞ্চ লাইসিতে (laïcité) হলো একমাত্র সঠিক সেক্যুলারিজম, তাহলে অবশ্যই এর মৃত্যু ঘটেছে। ঐ ধরণের কট্টর সেক্যুলারিজম এখন বেশিরভাগ জায়গাতেই সম্ভবত অবাস্তবোচিত (impractical) এবং অবাস্তবায়নযোগ্য, এমনকি তুরস্কেও। অপরদিকে, রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ‘ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর’( religious communities) সাথে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখার যে প্রশ্ন, এটা একটা মুশকিলের ব্যাপার, বিশেষ করে একটা বড় দেশে যেখানে বহু ধরণের মানুষের বাস। যখনই এরকম একটা ধারণা হাজির হয় যে, রাষ্ট্র কোনো একটা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদেরকে অন্য একটি সম্প্রদায়ের লোকদের উপরে গুরুত্ব দিচ্ছে বা পক্ষ নিচ্ছে, তখনই আপনি এমন সব বিবাদের উদ্ভব দেখতে পাবেন- যেগুলাকে ধর্মীয়( religious) ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করা হবে, আর রাষ্ট্র বাধ্য হবে বিবাদে দুইটা অবস্থানের যেকোনো একটার দিকে যেতেঃ হয় রাষ্ট্র কোনো একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নিবে, এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন নিছক নাই হয়ে যেতে পারে অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে; অথবা, রাষ্ট্রকে এটা প্রমান করতে হবে যে সে আসলেই কোনো একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে না। সেক্যুলারিজমের সমস্যা এখনই উধাও হয়ে যাচ্ছে না। এই সমস্যা থেকে যাবে।
কলাম্বিয়াঃ আপনি কি এমন স্ব-শাসন ব্যবস্থার রুপকল্পনা করতে পারেন- যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা বিধানপ্রস্তাব রাষ্ট্রের কাছে উপস্থাপন করতে পারে? যাতে রফাকারী (arbitrator) হিসেবে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা, তার অবসান হয়?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ একটা বিষয়ে আশিস সবসময়েই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যখনই কোনো ধর্মীয় সংঘাতের (religious conflict) উদ্ভব হতো, বৃহৎ বহিঃশক্তিগুলির হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকলে– স্থানীয় জনসমাজ নিজেরাই প্রায়শই সংকট নিরসনের পথ বের করে ফেলতো। এবং এটা হয়তো সত্য হতেও পারে, কিন্তু এই বৃহৎ শক্তিগুলির ঢুকে পড়া এড়ানোর উপায় কী? স্বশাসিত নগর বা গ্রাম ব্যবস্থা আর পাবেন না। ফলে বৃহৎ শক্তি হাজির হবে, বড় বড় রাজনৈতিক দল চলে আসবে, বড় বড় রাজনৈতিক আন্দোলন চলে আসবেই। স্থানীয় রাজনীতির উপরে তাদের প্রভাব ফেলতে থাকবে। এড়ানোর উপায় নেই।
কলাম্বিয়াঃ নন্দীর একটা আলাপ হলো, “বিশ্বাস-এর সাথে মিশে থাকা স্বভাবজাত সহনশীলতা” ভারতের স্থানীয় প্রাক–আধুনিক ধর্মগুলির একটা মূল উপাদান ছিল। এবং এটাই আধুনিকতাবাদ-বিরোধী অবস্থানের অপরিহার্য অংশ যা আদর্শ হিসেবে সেক্যুলারিজমের জবরদস্তিমুলক আরোপকে খারিজ করে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ এখানে সমস্যা হলো, যদি দেখেন যে আধুনিকতা এই সমস্যার উৎস, এবং স্বীকারও করেন এটা, তখন প্রশ্ন আসবে— কিভাবে কেউ আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে মুক্তি পেতে পারে? এটা কীভাবে বলবেন যে আমরা পরস্পরের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে শ্রদ্ধা করার এক ধরণের প্রাক- আধুনিক সামাজিক মূল্যবোধে ফিরে যেতে পারবো এবং তখনো কোনোভাবে পরস্পরের সাথে মিলে মিশে থাকতে সক্ষম হবো? বাস্তবতা হলো, আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে, যেখানে আপনার ভোট আছে, বিভিন্ন রকম জনগোষ্ঠী আছে, এবং এসব সংখ্যা এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সংখ্যাগুরু ‘ধর্মীয়’ জনগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু ‘ধর্মীয়’ জনগোষ্ঠী’র সংজ্ঞাও নির্ধারিত হয় সংখ্যার বিচারেই। আপনি এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না যে, নাগরিকত্বের আধুনিক শর্তাবলীর অধীনে যাদের সংখ্যা বেশি তাদের মধ্যে সবসময়েই অন্যের উপরে নিজেদের মতামতকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকবে। যারা সংখ্যায় কম, যারা ‘সংখ্যালঘু’, তাদেরকে রক্ষা করার উপায় অবশ্যই খোদ রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে। এর বাইরে যাবার কোনো রাস্তা আমি দেখতে পাই নাI
কলাম্বিয়াঃ তাহলে আধুনিকতাকে অস্বীকারের এই ব্যাপারটা কি যুক্তি-অভিজ্ঞতা-বিবর্জিত চিন্তা?
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ঃ আমি এটা বলবো যেঃ আধুনিকতার উৎপত্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আরো ভালো বুঝ পাবার জন্যে এগুলি প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণ। এগুলি দিয়ে খেয়াল করা যায় যে আধুনিকতা রেডিমেইড অবস্থায় হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে নাই। এটাও খেয়াল করা যায় যে, ‘আধুনিকতা’ যে আসছিলো– তার প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কিছু জিনিস হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার মানে এই না যে, যা কিছু হারিয়ে গেছে সেসবকে আর পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং ফিরিয়ে আনা যাবে। সেগুলি এখন আর কাজ করবে না। কোনো বাস্তবতা-শর্ত বা উপায় আমাদের নাই যা ওগুলাকে এখন আর কাজ করাতে পারে।
সিরিজ সম্পাদক-অরূপ রাহী।। প্রুফ রিডিং- হাসিবুল হাসান শান্ত।। কপি এডিটিং- জাকারিয়া হোসাইন