রচনাকালঃ শ্রাবণ ১৪২৫; জুলাই ২০১৮।
১।
‘দেশ সমস্যা অনুসারে, ভিন্ন বিধান হতে পারে’- লালন ফকির
বাংলাদেশের মতন দেশ এবং সমাজে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রবাদ ও সেই ঔপনিবেশিক পুজিবাদী উদারনীতিবাদের মাপে ‘বাংলাদেশ’কে একটা ‘পশ্চিমের মত করে’ ‘সফল উদারগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বানানোর যাত্রা একটা ঐতিহাসিক ফাঁদ কিনা, কীভাবে তা ফাঁদ- সেসব বিবেচনার সময় উপস্থিত বইলা আমরা মনে করি। কেন, কীভাবে, সে আলোচনা আমরা করবো, কিন্তু তার আগে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিত চকিতে দেইখ্যা নেয়া যাক।
২।
বহু বহু যুগের জানা ইতিহাসের এই অঞ্চল এবং এর জনগোষ্ঠী বহু অভিজ্ঞতার পথ ধইরা আজকের বাংলাদেশ নামে রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা নিছে। এর অতি সাম্প্রতিক কিন্তু প্রভাবশালী রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, তার মধ্যে বাঁচা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও অভিজ্ঞতা। গত ৫০ বছরের ১৫ বছর/১৭ প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষ সামরিক শাসন, শুরুর ৩ বছর এক দলীয় শাসন, ২০০৭-২০০৮ সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আর এর বাইরে বাকী সময়টা, বিভিন্ন মেয়াদের নৈর্বাচনিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অভিজ্ঞতা নিয়েছে বাংলাদেশ। এই পুরা সময়ের মধ্যে ঘটেছে বেশ কিছু ব্যর্থ ক্যু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের পতনের কালে ১৯৪৭-এ তৎকালীন পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামে । পাকিস্তান দুই যুগ পূর্তির সময়ের মধ্যেই সেই পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ।
গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন এখন যেমন শক্তিশালী রেটরিক, ৭০ দশকে ততটা ছিলো না, যদিও পাকিস্তান পর্বে বাংলাদেশ ৭০ পর্যন্ত ‘উন্নয়নের দশক’ পার করছিলো। কাপ্তাই বাঁধের মতন ভয়ঙ্কর জুলুমের প্রকল্প তখন নেয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে ‘গণতন্ত্র’, ‘সাম্য’ এবং ‘মানবিক মর্যাদা’র প্রতিষ্ঠাকে মুক্তিযুদ্ধের এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কারণ (raison d’être) হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
৩।
জাত-পাত-লিংগ-ধনী-গরীব ইত্যাদি বিভাজনজনিত বৈষম্যের অভিজ্ঞতা এবং তার বিরুদ্ধে জনসমাজে বিকশিত নানামাত্রিক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় বিকশিত সাম্যের ধারণা এবং পরে পশ্চিমা আলোকায়ন প্রকল্পের বুর্জোয়া ‘সাম্য’ ধারণা এবং ‘মার্ক্সিস্ট’/ ‘বামপন্থী’ রাজনীতির অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গী- সব মিলায়া বাংলাদেশ অঞ্চলে সাম্য এবং মানবিক মর্যাদার নিজস্ব সাম্প্রতিক ধারনাসমষ্টি গইড়া উঠছে । এই ধারণাপ্রবাহের কোনো একহারা এবং একমাত্রিক অর্থ সমগ্র সমাজে নাই। লিংগ, জাতি, সক্ষমতা, শ্রেনী ও অন্যান্য পরিচয় এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্বের মাত্রাভেদে এই ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ‘সাম্য’র ধারণার এই অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপুর্ণ উপস্থিতি ছিলো এবং আছে।
সমাজ এবং জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের ‘সাম্য’ এবং ‘মানবিক মর্যাদা’ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠছিলো প্রাক-ঔপনিবেশিক, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং ‘পাকিস্তানী’ লুটেরা এলিটের শোষন-লুটপাট, অত্যাচার-নিপীড়নের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উঠতি এলিটের রাজনৈতিক পরিভাষায় তা এক বিশেষ অর্থ এবং মাত্রা ধারণ করে, অন্যদিকে আরো ভিন্ন মাত্রা প্রবাহ আকারে থেকে যায় সমাজের প্রান্তিক অংশে।
জনগোষ্ঠী এবং সমাজ হিসেবে ‘আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার’, নিজস্ব জীবন ও সম্পদের অধিকার, সংস্কৃতি এবং জীবনধারা বিকাশে নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকারবোধ থিকাই সাম্য এবং মানবিক মর্যাদার নতুন ধারণার বিকাশ এবং তার প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য উপায় হিসেবে গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা অনুশীলনের তাগিদ আসে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি এলিট শাসনক্ষমতা হাতে নেবার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি এলিটের কাছে গণতন্ত্র ছিলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাবার বৈধ উপায়। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার ভাষাও ভোট রুপে দেখা গেছে ৭০-এর নির্বাচনে। কিন্তু সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ আরো বড় এবং গভীরভাবে গণতন্ত্রের সংগ্রাম হিসেবে হাজির হয়- যে গণতন্ত্রের ভাষা এবং অনুশীলন পশ্চিমা উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের ভাষা এবং অনুশীলন থিকা আলাদা ছিলো।
তখন লীগের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে ‘সমাজতন্ত্র’ থাকার একটা বড় কারণ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক- সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট রচনায় বামপন্থী-কমিউনিস্টদের আধিপত্যশালী ভূমিকা, যার চাপে বাংগালী জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘সমাজতন্ত্র’ রেটরিক কাজে লাগানো ছাড়া উপায় ছিলো না। যদিও বামপন্থীরা ‘বাস্তব রাজনীতিতে’ পিছিয়ে পড়ে, লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নেয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে। দল বা সরকারগুলি যাই করুক, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা গণতন্ত্রের এই আলাপ এবং ধারণা একটা দিক ছিলো পশ্চিমা মডেলের গণতন্ত্র করা, আরেকদিকে ছিলো ‘সমাজতন্ত্র/সাম্যবাদী’ সমাজ সংস্থানের সাপেক্ষে গণতন্ত্র অনুশীলন।
জেনারেল এবং প্রেসিডেন্ট জিয়া ও এরশাদের শাসনকালে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় শর্তের কারনে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্রের ধারণা বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কড়িমুল্য পাইতে শুরু করে। ততদিনে দুনিয়ায় সোভিয়েত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ দূর্বল এবং পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘গণতন্ত্রায়ন’ প্রকল্প জোরদার হইতে শুরু করে। পুরা সময়টাতে বাংলাদেশে বামপন্থী চিন্তা এবং রাজনীতি তার সৃজনশীলতা হারায়ে ক্রমশঃ অনির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির আলাপ থেকে সাম্য আর মানবিক মর্যাদার প্রসংগ ক্রমশঃ হারায়ে যাইতে থাকে।
৪।
সবুজ বিপ্লব, উদারীকরণ এবং প্রবৃদ্ধি মডেলের উন্নয়ন নীতি ইত্যাদি অনুশীলনে বিপুল পশ্চিমা ‘সহযোগিতা’ ৮০’র দশকে শুরু হয়ে পুরা ৯০ পর্যন্ত চলে নতুন শতকের প্রথম দশক পার হয়। বর্তমানে, পরিবর্তিত বৈশ্বিক রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ক্ষমতাবিন্যাসের কারণে আগেকার দান-খয়রাত মডেলের ‘সহযোগিতা’র ধরণ পাল্টে গেছে। এখন মূলতঃ এই ‘সহযোগিতা’ অবকাঠামো, প্রতিরক্ষাসহ কৌশলগত বিনিয়োগ এবং বৃহৎ মুনাফার আরো সব খাতে বিভিন্ন দেশ/কোম্পানির দখল/বিনিয়োগ/ব্যবস্যা এবং নিয়ন্ত্রণের প্রবণতার দিকে মোড় নিছে।
নতুন ভূ-রাজনৈতিক এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ প্রধান প্রধান বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সাথে নতুন নতুন ধরণের অর্থনৈতিক , কুটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কে যুক্ত হইতেছে, কিন্তু শাসন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত আলাপে পশ্চিমা পুজিবাদী উদার গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইত্যাদির কথা চললেও, ক্লায়েন্টেলিস্ট/মক্কেলতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো অব্যাহত রাখতে ‘উদার গণতন্ত্রের’ বৈধ/গণতান্ত্রিক ‘আইনের শাসন’ চর্চিত না হয়া এখানে চলতেছে ‘আইনের দ্বারা শাসন’। স্থানীয় ক্ষমতাশালীর ‘আদিম-সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার’ সাথে বৈশ্বিক পুজি ও ক্ষমতার মিল-বিরোধের নানামাত্রিক জটিল কিন্তু প্রধানভাবে অধীনতার সম্পর্কের মধ্য দিয়া যাইতেছে বাংলাদেশ।
প্রত্যক্ষ্য ঔপনিবেশিক শাসনের পর্বে ক্ষমতা সম্পর্কের মক্কেলতান্ত্রিক নতুন বিন্যাস পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পর্বে আরো বিস্তৃত এবং গভীর হইছে সমাজে, তার সাথে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি-বৈশিষ্টের দ্বন্দ্ব এবং অমীমাংসার ফলে জটিল এক সামাজিক- সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দশার সৃষ্টি হইছে। এসব সম্পর্কের দুইটা বড় দিকঃ জনসমাজে গণতন্ত্রের একটা পশ্চিমা উদারনীতি মডেল কে এই সমাজের লক্ষ্য হিসেবে গরীব, মধ্যবিত্ত এবং এলিটের একটা বড় অংশের মধ্যে বাসনা তৈরী করা; বৈশ্বিক সুশাসন দৃষ্টিভঙ্গী জারি রাইখ্যা বৈশ্বিক পুজিতান্ত্রিক শক্তি এবং স্থানীয় এলিটের জন্যে সুবিধাজনক বাস্তবতা জারী রাখা হইতেছে। তুলনামূলক দীর্ঘ সময় ধরে স্বনামে সামরিক শাসন সব সময় এসব উদ্দেশ্যে ফলপ্রসূ হয় নাই। ফলে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ধাঁচের শাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হইতেছে আর আলাপে থাকতেছে গণতন্ত্রের একটা পশ্চিমা উদারনীতি মডেল। লক্ষ্য হিসেবে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক উদার গণতন্ত্র চাওয়ার ফলাফল অনেক, আমরা তার কিছু উদাহরণ বলতে পারি। যেমন সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের হীনমন্যতাঃ ‘আমরা একটা ‘উদার গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা এবং অনুশীলনে ‘ব্যর্থ’ ইত্যাদি; অর্থনীতি এমনভাবে সজ্জিত হইছে যাতে দেশ-বিদেশের কতিপয়ের সুবিধা নিশ্চিত হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষ -প্রকৃতি সম্পর্কের বিষোৎপাদনমূলক পরিবর্তন; ঔপনিবেশিক লিংগায়ন, ধর্ম – সংস্ক্রিতি-বর্ণ- সামর্থ্য’র বৈষম্যমুলক অনুশীলন গভীর হওয়া ইত্যাদি।
স্থানীয় এবং ভূরাজনীতিগত অনেক শর্ত বাংলাদেশে চলমান ক্লায়েন্টেলিস্ট ক্ষমতা সম্পর্ককে আরো গভীর এবং বিস্তৃত করছে গত ৪ দশকে। এর সাথে ‘উইনার টেকস অল’ নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘প্রান্তিক পুজিবাদী’ এই দেশে ‘উদার বুর্জুয়া’ কায়দায় ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়ে ওঠেনা শাসক এলিটদের পক্ষে। ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র পরীক্ষায় বারবার আপাতঃনৈর্ব্যক্তিক জরুরতের কারনে ‘ফেল’ করতেছে। একই শর্তজাল বহাল থাকলে এই দেশের ‘উদার গণতন্ত্র’ বাস্তব রূপ লাভ করা তাত্ত্বিকভাবেই অসম্ভব। এই ক্ষমতা-সংস্কৃতি সম্পর্ক ভাইংগ্যা একটা ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বা ‘নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বামপন্থী রাজনীতির জন্যেও উদাহরণবিহীন এক তাত্ত্বিক এবং বাস্তব চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হইছে।
পশ্চিমা উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের ঔপনিবেশিকতার ভিত্তি এবং প্রক্রিয়া পর্যালোচনা না কইরা এই আলোচনা আগানো সম্ভব না।
৫।
পশ্চিমে বিকশিত উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক- সাংস্কৃতিক উৎস হলো ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা। উপনিবেশ ব্যবস্থা যে ক্ষমতার চর্চা করে, তা উপনিবেশিত অঞ্চলে ক্ষমতার একটা ঔপনিবেশিকতার জন্ম দেয়। ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা একটা সমাজের জ্ঞানকাণ্ড – জ্ঞান প্রক্রিয়া, সম্পদ ও সহায়, যৌনতা – লিঙ্গায়ন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস- সবখানে প্রভাব ফেলে । এভাবে ‘পশ্চিমা উদারনীতিবাদী গণতন্ত্র’ দুনিয়ায় বহু অঞ্চলে সাবেক প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং এখনকার অপ্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক- বিশ্বপুজিবাদী ক্ষমতা সম্পর্ককেই টিকে থাকতে সাহায্য করতেছে। সাম্প্রতিককালের ‘বিশ্বায়ন’ বা কর্পোরেট বিশ্বায়ন সেই চলমান পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ার একটা পর্ব মাত্র। অন্য আরো দ্বান্দ্বিক প্রভাব থাকলেও ‘পশ্চিমা উদারনীতিবাদী গণতন্ত্র’- এর আলাপ-অনুকার- চর্চার মাধ্যমে প্রধানতঃ উপনিবেশিত সমাজগুলিতে সমাজ-রাষ্ট্রের এমন একটা পুনর্বিন্যাস আনে, যা ঔপনিবেশিক পুজিশক্তির স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখে, উপনিবেশিত সমাজগুলির স্বাধীন, স্বতন্ত্র বিকাশের পথ বন্ধ কইরা দেয়। বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্র এই সম্পর্কের অধীনতার মধ্যে আছে।
‘পশ্চিমা ঔপনিবেশিক উদারনৈতিক গণতন্ত্র’ সকল কথিত ধনীদেশের প্রান্তিক মানুষজন, কথিত গরীব দেশ, নারী ও অন্যান্য লিংগের মানুষ, শ্রমিক, প্রাণ-প্রকৃতি ব্যবস্থার ভর্তুকি নির্ভর। তাদের ‘সেক্যুলারিজমের’ ধ্যান-অনুশীলন গভীর সংকটে। জীবন ও সমাজের সকল দিকে সামরিকায়ন ও ‘নিরাপত্তায়ন’ ক্রমবর্ধমান, ‘মানবাধিকার’ সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের হাতিয়ারে পরিনত, পুরুষতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক লিংগব্যবস্থার অভিঘাতে বিপুল মানুষ পর্যদুস্ত। ঔপনিবেশিকতার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ গণহত্যা, খুন, উচ্ছেদসহ নানামুখী জুলুমের আদর্শিক-রাজনৈতিক উৎস এবং ঢাল হিসেবে কাজ করতেছে। আর এসব কিছু পশ্চিমা উদারনৈতিক ঔপনিবেশক গণতন্ত্রকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ কইরা চলছে।
পশ্চিমা ঔপনিবেশক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্র যে বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভুসমাজের স্বার্থ-ইচ্ছা-অভিজ্ঞতায় তাদের সমাজে গড়ে উঠেছে, এর ফলে সেসব সমাজে যে ধরণের সামাজিক-আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে, যাতে কইরা সেসব সমাজে তাদের মতন ‘উদারগণতন্ত্র’ চলে আসছে, বাংলাদেশসহ ‘উত্তর উপনিবেশিক’ সমাজগুলিতে তার না পুনরাবৃত্তি সম্ভব, না সম্ভব পশ্চিমা ঔপনিবেশক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে মডেল বা ছাঁচ হিসেবে নিয়ে সেসবকে এইসব উত্তর-উপনিবেশিক সমাজে প্রতিস্থাপন। পশ্চিমা ঔপনিবেশক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে নেয়ার ফলে অনেক উত্তর উপনিবেশিক সমাজে নতুন সামাজিক- সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট এবং নতুন নতুন রাজনৈতিক- শাসনতান্ত্রিক- সমাজবিধানিক সংকটের জন্ম দিয়া চলতেছে।
এটাই আমাদের ভাষায় উত্তর উপনিবেশিক সমাজগুলির উদার গণতন্ত্রের ফাঁদ । এই ফাঁদ কেউ সক্রিয় ইচ্ছায় পাইত্যা রাখে নাই। বরং এটা অনেক সক্রিয় রাজনৈতিক সত্তার জটিল বিন্যাসে সৃষ্ট ইতিহাসের এক পর্যায়, যার বাস্তব প্রক্রিয়া আমাদের সমাজের জন্যে ফাঁদ হিসেবে দেখা দিছে, যে বাস্তবতার অভিজ্ঞতা জীবসমাজ হিসেবে সামস্টিক স্বার্থের বিচারে নেতিবাচক। বাংলাদেশের এই মুহুর্তের চলা হলো পশ্চিমা ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্র আলাপ-অনুকার- চর্চায় থাকা মানে পরাধীনতার, হীনমন্যতার, বৈষম্যের, ‘মানবিক মর্যাদাহীনতা’র বহুমাত্রিক ফাঁদে খাবি খাওয়া ।
৬।
সমাজ-রাজনীতি পরিবর্তনের যেসব প্রকল্পের আদর্শিক/দার্শনিক ভিত্তিমূলে আছে ইউরোপকেন্দ্রিক প্রগতিবাদ, ‘আধুনিকতাবাদ’, আর ‘সভ্যকরণ’ প্রকল্প, যা পশ্চিমা-পুজিবাদী – উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের ভিত্তি, একটা সমাজের নিজস্ব সামাজিক- দার্শনিক সংকট- সম্ভাবনাকে চাপা দিয়া সেসবের অনুকরণ যে কোনো নতুন সমাজে নতুন সামাজিক- দার্শনিক সংকট তৈরী করে সমস্যাকে আরো জটিল করে মাত্র। ইতিহাসে কর্তাসত্তার ভূমিকা আছে বটে, কিন্তু ইতিহাস সরল রৈখিক প্রগতিবাদী পথ ধরে বিকশিত হয় না বা হচ্ছে না। ইতিহাস দেশ-কাল-পাত্রভেদের নির্মিতি।
ফলে, পশ্চিমের উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতাকে উপনিবেশিত সমাজে নির্বিচারে অনুকরণ-অনুসরণ আজকের দিনের ঐতিহাসিক- দার্শনিক কান্ডজ্ঞান সমর্থন করেনা। ইতোমধ্যেই, বহুঅভিজ্ঞতা- বিশ্লেষণ প্রমাণ করছে, পশ্চিমা ঔপনিবেশক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্র সার্বজনীন মঙ্গলের রাস্তা নয়। এই রাস্তায় উপনিবেশিত সমাজে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার পূনর্বিন্যাস ঘটে মাত্র। এসব অভিজ্ঞতা এবং বহু সমাজে প্রবহমান লোকায়ত জ্ঞান-প্রজ্ঞা আমাদের সার্বজনীন কুশল-মঙ্গলের নতুন ধ্যান-অনুশীলনের পথ দেখাতে পারে। সে আলোচনা অন্যত্র।
এ অঞ্চলে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের বহু ধারার মধ্যে বহুধাবিকশিত প্রভাবশালী এক ধারাসমষ্টি ‘বামপন্থী / প্রগতিশীল’ হিসেবে পরিচিত। এসব ধারার একটা বড় অংশ সাবেক উপনিবেশ এবং বর্তমান/নয়া উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ‘নয়া গণতন্ত্রিক’ বিপ্লব/সংগ্রামের ধারণা হাজির ও অনুশীলন করেন। লক্ষ্যনীয় হইলো, অনেক ক্ষেত্রেই নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব ‘ইউরোপকেন্দ্রিক’, ‘প্রগতিবাদী’ , ‘আধুনিকতাবাদী’ এবং ‘সভ্যকরণ’ ভাবনা দিয়া নির্মিত-প্রভাবিত আর ইউরোপীয় সমাজ বিশ্লেষনী বর্গ এবং ধারণা দিয়া গঠিত, যার অনেক কিছু দিয়াই বাংলাদেশের মতন সমাজ বিশ্লেষন করা যায় না, ধরা যায়না এই সমাজের অনেক দিকঃ দ্বীন, ধর্ম, উপাসনা, জীবনধারা- জীবনব্যবস্থা, সমাজসংস্থান- কিছুই। ফলে ‘নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবে’র এর ঔপনিবেশিক ভিত্তি নিয়া যারা ‘বাম-প্রগতিশীল’, তাদের ভাবার , গণতন্ত্রের ধারণা এবং অনুশীলনের বি-উপনিবেশায়নের জরুরত নিয়ে ভাবার জরুরত আছে। ‘বিপ্লব’-এর ধারণাও তাই নতুন কইরা বিচার করা জরুরী।
কেন আমরা ‘সাম্য’ আর ‘মানবিক মর্যাদা’কেই নতুন বিউপনিবেশিক রাজনীতির সংগঠক ধারণা হিসেবে নিলাম? কারণ, এই ‘সাম্য’ আর ‘মানবিক মর্যাদা’-র আকাঙ্খাই সমাজকে সামষ্টিক পরিবর্তনের লড়াইয়ে সামিল করে, অন্য কিছু নয়। ‘সাম্য’ আর ‘মানবিক’ মর্যাদার প্রাক-ঔপনিবেশিক নানান প্রজ্ঞা, উপনিবেশের কালে উপনিবেশিক জুলুম বিরোধী লড়াইয়ে বিকশিত ধারণা আর ‘উত্তর-উপনিবেশিক’ কালে বিকাশমান বিউপনিবেশিক ধারণা-অনুশীলনই সামগ্রিক কুশল-মঙ্গলের সমাজবিধান রচনা-অনুশীলনের পথ। সেই সার্বজনীন কুশল-মঙ্গলের বিচার কারো একার মতে নয়, একক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় নয়, নয় একদেশদর্শিতার ভিত্তিতে। বরং বহুরৈখিক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়া।
বিউপনিবেশায়ন বলতে আমরা এখানে কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান বুঝাইতেছি না। বরং জ্ঞানব্যবস্থা-প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার অবসান বুঝাইতেছি। পশ্চিমা ঔপনিবেশক পুঁজিবাদী “উদারনৈতিক”-“সেক্যুলারিস্ট”-হেটেরোসেক্স্যুয়ালিস্ট গণতন্ত্র, তার জ্ঞানব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাব থিকা নিজেদেরকে মুক্ত কইরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা তথা মঙ্গলের নতুন ধ্যান-অনুশীলনকে বুঝাইতেছি এবং অতি অবশ্যই প্রাচীন/ স্বর্ণযুগ/ ‘গৌরবজনক’ যুগ/ব্যবস্থায় ‘ফিরে’ যাবার রোমান্টিক ভাবালুতার কথা আমরা বলতেছিনা। ওটা সম্ভব না ইতিহাসে। আমরা বলতেছি ঔপনিবেশিক উদারনীতিবাদ এবং আমাদের অঞ্চল-সমাজবিধান – দুইয়েরই সম্যক বিচার-পর্যালোচনার কথা। আমরা বলতেছি ‘দেশ-সমস্যা’ অনুসারে এই জীবন এবং সমাজব্যবস্থা-ক্ষমতাসম্পর্কের রূপান্তর ঘটায়ে বিউপনিবেশিক জীবন এবং সমাজবিধান গড়ে তোলার কথা।
বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার এখন মঙ্গলসংগ্রামের একটা রাস্তা হতে পারে সমাজসংস্থা, রাষ্ট্রপ্রকল্প এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও সম্পর্ক সব কিছুর বিউপনিবেশায়ন। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা কইরা, ‘সাম্য’ ‘গনতন্ত্র’ আর ‘মানবিক মর্যাদার’ নিজস্ব, বিউপনিবেশায়িত ভাবনা-অনুশীলন-চর্চা করতে হবে। দুনিয়ার বিউপনিবেশায়নের সংগ্রামের অভিজ্ঞতায়, নিজের অভিজ্ঞতায়, শিক্ষায়, স্বাধীনতার নতুন এক সংগ্রাম যাত্রা।
এই পথ নতুন, কেবল চলার মাধ্যমেই এই রাস্তা তৈরী হয়। এই পথ দুর্গম, কিন্তু সৃজনশীলতার , মুক্তির, যুক্ততার। আমাদের মুক্তি পাবার সম্ভাবনা তৈরী হবে ঔপনিবেশিকতার ক্ষত থেকে, নিজেকে নিজে অমর্যাদা করা থেকে, অপরকে অশ্রদ্ধা করা থিকা। যুক্ততা নিজের সঙ্গে নিজেরঃ উপনিবেশ যাতে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি কইরা রাখছে। যুক্ততা সকলের সংগেঃ বর্ণবাদ, লিঙ্গায়ন এবং শোষন-নিপীড়ণমূলক সবরকম ক্ষমতাকাঠামোর মাধ্যমে আন্তঃসামাজিক এবং অন্তঃসামাজিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তোলা রইছে। ফলে, বি-উপনিবেশায়ন দুনিয়ায় সাম্য এবং মানবিক মর্যাদার নতুন এক বাস্তব সম্ভাবনা হাজির করে। তাই সাম্য এবং মানবিক মর্যাদার নতুন, বি-ঔপনিবেশিক ধারণার ভিত্তিতে বি-উপনিবেশায়িত গণতন্ত্রের বা বিউপনিবেশিক গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া অনুশীলন করা দরকার, যাতে সাম্য এবং মানবিক মর্যাদা কেবল অনুমানের বিষয় হিসেবে না থাইক্যা বর্তমানের সাধনার বিষয়ে পরিনত হয়।
এই সংগ্রাম সাধনা ঔপনিবেশিক-আধুনিক -পুজিবাদী – পরিচয়ফ্যাসিবাদী তথা জুলুমশাহী রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরাধ্য ও মনজিলে মকসুদ বিবেচনা করবেনা। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ, সীমান্ত-সার্বভৌমত্বের ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী-পুজিবাদী ধারণা ও চর্চা, পুরা জুলুমশাহীকেই মূলে খারিজ করতে থাকবে।
#
গ্রন্থপঞ্জীঃ
লালন ফকির পদাবলী ।
Aníbal Quijano (2007). Coloniality and Modernity/Rationality ;
Maria Lugones. (2008). The Coloniality of Gender;
Frantz Fanon( 1961 ) The Wretched of the Earth.
#
কৃতজ্ঞতাঃ
যাদের সাথে এই লিখা এবং লিখার বিষয় নিয়া আলাপ কইর্যা উপকৃত হইছিঃ মিথিলা মাহফুজ, হিয়া ইসলাম, জাকারিয়া হোসাইন অনিমেষ, মোহাইমিন লায়েছ, সাফিয়েহ গ্রেইস কবীর । এছাড়া দুনিয়ার বহু লড়াকু তাত্ত্বিক/রাজনৈতিক কর্মী , যাদের সংগ্রাম আমার চিন্তা–কাজকে সমৃদ্ধ করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। লিখার সীমাবদ্ধতার সব দায় আমার।