সাধারণভাবে ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের কাছে ‘বাউল- ফকির’ ইত্যাদি এখনো রোমান্টিক কল্পনার ব্যাপার। এই কল্পনার জগত নির্মানে অনেক গবেষণা , প্রকাশনা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, সম্প্রচার এবং সাহিত্যিক রচনার অবদান আছে। এই কল্পনা বাস্তব বিবর্জিত নয়, বাস্তবের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশন এবং পাঠ সঞ্জাত।
এই পরিবেশনার ইতিহাস যদি আমরা খেয়াল করি, এর দুইটা কালপর্ব দেখতে পাই। ১/ কথ্য সংস্কৃতির কালপর্ব, ২/ ছাপা এবং সম্প্রচার প্রযুক্তির কালপর্ব। কথ্য সংস্কৃতির কালপর্ব , যা কিনা মুদ্রন প্রযুক্তির প্রসারের আগের ঘটনা , সেটা নিজেই বাউল-ফকির সাধনার নানান ধারা-উপধারা বিকাশের কালপর্ব। বাংলা এবং ভারতীয় ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে সেটা অনেকটাই প্রাক উপনিবেশ এবং উপনিবেশকালে বিভিক্ত।
চৈতন্য চরিতামৃত বলেন, ‘লিখিয়া ঢাকিল’ । প্রাক-উপনিবেশ কালেও লিখা হইতো- পুঁথি আর কড়চা, কিন্তু সেটা হাতেলিখার কাল, মুদ্রন যন্ত্র আসে নাই। মুদ্রনযন্ত্র আসার পরে, সেই ‘অকথ্য কথন’ ‘অকৈতব ধন’-এর খবর- সব নিয়ে ‘গবেষক’ আর ‘সংবাদ’কারীর চেষ্টা শুরু ছাপার অক্ষরে তার ‘খবর’ করার। কথ্য সংস্কৃতির কালের ‘অকথ্য কথন’, যা ‘লিখিয়া ঢাকা’ হইলো চৈতন্য চরিতামৃতের মতে , মুদ্রন প্রযুক্তির কালে ছাপা-সম্ভব হইতে পারে কি? যা ছাপা সম্ভব ছাপার কালে, তা কি ‘লিখিয়া ঢাকার’ অকথ্য কথন’ আর আছে?
২।
লালন ফকির এর লীলা প্রকাশকাল পুরাটাই বাংলায় উপনিবেশের কাল। এই কালে ‘ভারতবিদ্যা চর্চা’’ বা ‘ইন্দোলজি’ বিশেষ মাত্রা পায়, ঔপনিবেশিক শাসকদের নিজস্ব প্রয়োজনে। সে কালে অনেক ‘ক্ষেত্র গবেষনা’ বা ‘ফিল্ড রিসার্চ’, এবং এথনোগ্রাফি’ক গবেষণা শুরু হয়, এই অঞ্চলের জনসমাজের স্বরুপ বুঝতে। সে ধারাতেই ‘বিদেশী’ এবং অনেকের উপনিবেশিক চোখে রচিত হইতে থাকে এখানকার বহুপরিচয়ের মাষজনের পুজা-উপাসনা-জীবনাচার ইত্যাদির খোঁজখবর করা নানান পুস্তক।
তার কিছু পর, ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার জগতের মধ্য থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতির সুলুক সন্ধান শুরু হয়, রচিত হইতে শুরু করে অনেক পুস্তক। এখানে শুধু যদি কয়েকজন ‘বাংগালী’ গবেষকের নাম উল্ল্যখ করতে হয়, তাইলে অতি অবশ্যই অক্ষয়কুমার দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, দীনেশ্চন্দ্র সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মনসুর উদ্দিন প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে হয়। আরো শতেক নাম আসবে, যদি বিস্তার করি আমরা। সেটা প্রসংগ নয়। প্রসংগ হইলোঃ বাউল- ফকির-সহজিয়াসহ এসব সম্প্রদায়ের পরিচয় সন্ধানের কারন, দৃষ্টি এবং উপায়-পদ্ধতিঃ কীভাবে সম্ভব চেনা-জানা?
৩।
উপরের প্রশ্ন এবং সেসবের সম্ভাব্য উত্তরে আমাদের মতের মিল না হোক, আমরা এটা বুঝতে পারি যে, অইসব গবেষনার কারন- দৃষ্টি – উপায়- পদ্ধতি এবং ফল আলাদা আলাদাঃ এই অর্থে, যে, একেক জনের একেক উদ্দ্যেশ্য ছিলো, ছিল একেক রকম ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস– ভাষা।
এই ভঙ্গি এবং ভাষার পার্থক্যের মীমাংসা হয় না বলেই অনেক গবেষণা হয়, অনেক গবেষণা লাগবে আরো আমাদের। এই পথ ধরেই প্রশ্ন আসবে- যে খোঁজে , যে জানতে চায় এত, ‘অন্য’র সম্পর্কে- তার সাথে এই ‘অন্য’র সম্পর্কও রচিত হচ্ছে এসব ‘গবেষণায়’। এই সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সচেতনতা’ সাম্প্রতিককালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গবেষণা্র প্রাথমিক স্বীকার্য্য। এহ বাহ্য।
৪। ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ অক্ষয় কুমার দত্ত মহাশয়ের বইয়ের নাম। আমরা বইয়ের নামটাই এখানে ব্যবহার করবো শুধু, বইটা নয়। তো, ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় নিয়া গবেষণা সমুহের প্রধান দুইটা বৈশিষ্টঃ কিছু আছে , যেগুলার প্রধান্য ‘ক্ষেত্র গবেষণায়’, এথনোগ্রাফি-তে, কিছুর আছে মতের ব্যাখ্যা এবং ভাষ্য রচনায়। যদিও ‘ক্ষেত্র গবেষণা’ পক্ষপাত বা মত বিচ্ছিন্ন হয় না। সেদিক থেকে প্রতিটা গবেষণাতে মত সয়ম্প্রকাশ। কিন্তু, আমরা যদি যদি ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’এর ‘আধ্যাত্মিকতা’র পরিচয় ইতিহাস সম্মতভাবে পাইতে চাই, আমাদের সম্ভবত আগে এসব ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’এর সামাজিক-ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা সম্যক বুঝা দরকার।
৫।
সেই বুঝার ক্ষেত্রেই ফিরোজ এহতেশামের এই সাক্ষাতকার, ‘সাধু’ ‘ফকির’ এবং ‘শিল্পী’দের সাথে, আমাদের সাহায্য করতে পারেঃ ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ –এর এই কালের একটা ধারা কীভাবে গবেষকদের সম্পর্কে, কিভাবে নিজেদের সম্পর্কে, সমাজ এবং ইতিহাস সম্পর্কে, মানে, ‘আধ্যাত্মিকতা’ সম্পর্কে।
এই সংকলনে ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-এর বিশেষত লালনপন্থী ধারার কিছু মানুষজনের সাথে ফিরোজ এহতেশামের সাক্ষাতকারের মধ্যে দিয়ে সাক্ষাতকার দাতারা লালন ফকির, ‘বাউল’, ‘ফকিরি’ নিয়েও অনেক মত-মনতব্য-ব্যাখ্যা দিছেন- সেসবের ব্যাপারে আলাপ বিস্তার এখানে সম্ভব না। কিন্তু নোট রাখা ভালো- এসব মত-ও অনেক মতের কিছু মত মাত্র। কাকে বলে ‘বাউল’, কাকে বলে ‘ফকির’ কাকে বলে ‘মানুষ’, কাকে বলে ‘মানবতা’, কাকে বলে ‘সাধণা’, কাকে বলে ‘জ্ঞান’, কাকে বলে ‘অনুমান’, কাকে বলে ‘বর্তমান’ কাকে বলে ‘মুক্তি’, কাকে বলে ‘সহজ’ কাকে বলে ‘জীব’, কাকে বলে ‘সামান্য’ আর কাকে বলে ‘বিশেষ’, কাকে বলে ‘সাধনা’ , কাকে বলে ‘মানুষের করণ’- সেসব নিয়া আলাপ-বাহাস-বাদ-সংবাদ-তর্ক-জল্প-বিতন্ডা ইত্যাদির জীবন্ত, ঐতিহাসিক, চাঞ্চল্যকর্ রোমাঞ্চকর ইতিহাস আছে ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’-এর, বাউল-ফকিরদের অবদান সেখানে বিপুল।
ঐসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের এখানে আলোচ্য নয়। এই বইয়ে সেসব প্রশ্নের নানান রকম উত্তরের কিছু নমুনা মিল্বে। কিন্তু আলোচ্য হইলোঃ উপনিবেশপুর্ব কালের ভাব-সাধনা-অভিজ্ঞতা, উপনিবেশ, পশ্চিমা আধুনিকতা, পশ্চিমা ‘মানবতাবাদ’ এর নানান রুপ-চেহারা-ভাষার সেই বহুধাবিস্ত্রিত ইতিহাসের সাবধানী পাঠ করতে গেলে আমাদের দরকার হবে ‘উপনিবেশ’ , ‘আধুনিকতা’ , ‘মানবতাবাদ’ ইত্যাদির ভেদ বুঝতে সক্ষম একটা মন। সেই সব সাধণার-উপাসনার ইতিহাসের রত্নভান্ডার আজকের দিনে কাজে লাগাতে চাইলে দরকার হবে আমাদের ‘গবেষক’ এবং ‘গবেষিত’র স্মৃতি -অভিজ্ঞতার, ইতিহাসের, এবং ‘বর্তমানে’র ‘বি-উপনিবেশিত’ পাঠ । রোমান্টিক কল্পনার পর্দা ভেদ করে বাউল-ফকির তথা ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের ভেদের খবর জানতে সেই চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে।
ফিরোজ এহতেশামের নেয়া সাধু-ফকির-শিল্পীদের এই সাক্ষাতকার সংকলন পড়তে গিয়া এসব কথাই আমার মনে আসলো। তার এই গভীর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভ্রমনের সার্বিক সাফল্য কামনা করি। আর পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাই ফিরোজ এহতেশামের এই ভ্রমণের সঙ্গী হইতে।
জয় গুরু। আলেক সাঁই ।
অরূপ রাহী। পৌষ ১৪২৪, ঢাকা।
( ফিরোজ এহতেশামের গ্রন্থ ‘ সাধুকথা’র মুখবন্ধ হিসেবে লিখিত। )